দশ পণ্যে রাজস্ব আহরণে ধসআমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের শুল্ককর যৌক্তিক হতে হবেমেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চায় আইপিডিস্বর্ণালংকারে ভ্যাট কমানোর দাবি বাজুসেরসিগারেটে কর বাড়ানোর আহ্বান এমপিদের
No icon

ভেস্তে যেতে চলেছে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা

উত্তরার ফেরদৌস ইফতেখার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) চাকরি করেন। এর আগে দীর্ঘদিন একটি মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার ফলে তিনি মোটামুটি প্রযুক্তিসচেতন। প্রায়ই অনলাইনে কেনাকাটা করেন। ব্যাংকের লেনদেনও করেন ঘরে বসেই। তবে তিনি ১৬ বছর ধরে আয়কর বিবরণী জমা দিয়ে কর দেন। কয়েক বছর ধরে কর কার্যালয়ের ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে কর মেলায় গিয়েই আয়কর বিবরণী জমা দেওয়ার কাজটি সারেন। গত বছর ফেরদৌস ইফতেখারের মনে হলো, কর মেলায় গিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়াটাও ঝামেলার। কারণ, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে যানজট ঠেলে তবেই ওখানে যেতে হয়। সে জন্য তিনি ঘরে বসেই অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে চাইলেন। কিন্তু সফটওয়্যারের নানা জটিলতায় তাঁর আর অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া হয়নি। কারণ, রিটার্ন দিতে হলে আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন নিতে হবে। আবার রিটার্ন দিলেও অনলাইনে কর পরিশোধ করা যাবে না। সেই ব্যাংকে গিয়েই পে-অর্ডার করতে হবে। এসব ভেবে শেষ পর্যন্ত অনলাইনের পরিবর্তে কর মেলায় গিয়েই রিটার্ন জমা দিলেন তিনি।

ফেরদৌস ইফতেখার বলেন, কর অফিসে হয়রানির ভয়ে অনেকে কর দিতে উৎসাহিত হন না। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে অনলাইনে রিটার্ন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এত জটিল প্রক্রিয়ার কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, এখন অনলাইনে যেভাবে সহজেই কেনাকাটা করা যায়, রিটার্ন ও কর পরিশোধের ব্যবস্থাও সহজ করা দরকার। তাহলে করদাতাদের কাছে এটি জনপ্রিয় হবে।

প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে ফেরদৌস ইফতেখারের মতো বহু করদাতা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না। ফলে এনবিআরের অনলাইন রিটার্ন জমা নেওয়ার উদ্যোগটি প্রায় ভেস্তে যেতে চলেছে।

করদাতাদের জন্য অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার কার্যক্রমটি চালু করা হয় চার বছর আগে, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে। এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। উদ্বোধনকালে তিনি নিজের বার্ষিক রিটার্ন অনলাইনে জমা দেন। কিন্তু প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেলেও তা তৃণমূল পর্যায়ের করদাতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়নি। কেননা অনলাইন রিটার্ন ব্যবস্থাটি করদাতাবান্ধব করা যায়নি। ফলে করদাতারা অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ায় তেমন উৎসাহ দেখাননি।

বছরে ছয় হাজারের কম রিটার্ন
বছরে গড়ে ছয় হাজারের মতো করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দেন। অথচ দেশে বর্তমানে ৪২ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে ২২ লাখের বেশি টিআইএনধারী তাঁদের বার্ষিক কর বিবরণী জমা দেন। কিন্তু গত বছর সব মিলিয়ে ৫ হাজার ৮৪৮ জন অনলাইনে রিটার্ন জমা দিয়েছেন। আগেরবার ৫ হাজার করদাতা ঘরে বসে রিটার্ন দিয়েছেন, যা রিটার্ন জমা দেওয়া মোট করদাতাদের দশমিক ২৫ শতাংশের মতো। এর মানে, গড়ে প্রতি চার শ জন রিটার্ন জমাকারীর মধ্যে একজন করদাতা ঘরে বসে রিটার্ন জমা দিয়েছেন।

করদাতারা কেন অনলাইনে রিটার্ন দিতে উৎসাহিত হন না এর কয়েকটি কারণ জানা গেছে। যেমন এনবিআর অনলাইনে রিটার্ন জমা নেওয়ার বিষয়ে তেমন প্রচারণা চালায়নি। অনলাইন সিস্টেমটিও করদাতাবান্ধব নয়। এ ছাড়া অনলাইনে কর পরিশোধের সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য হাফিজ আহমেদ মুর্শেদ বলেন, এখন আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সনাতনী ও অনলাইন দুটি পদ্ধতিই চালু আছে। একটি নতুন পদ্ধতি চালু হলে পরের কয়েক বছর এ নিয়ে করদাতারা তেমন একটা আগ্রহী হন না। অনলাইন রিটার্ন জমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাঁরা কর কার্যালয়ে গিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে কর দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

প্রকল্পের টাকা জলে গেল
কর বিভাগের অধীনে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর জন্য ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল মেয়াদে স্ট্রেনদেনিং গভর্ন্যান্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এনবিআর। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড ট্যাক্স (বাইট্যাক্স) সিস্টেম চালু করা হয়। এই প্রকল্পে মোট খরচ হয় ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে এই সিস্টেম বা সফটওয়্যার তৈরির কাজ পায় ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠান এফটিপি। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ৫১ কোটি টাকায় কাজটি রফা হয়। সেই কাজের অংশ হিসেবে অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার সফটওয়্যার, করদাতার তথ্যভান্ডার তৈরি করার কথা ছিল। কিন্তু পুরো অর্থ পরিশোধ করা হলেও এখনো ভিয়েতনামের ওই প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি কাজ বুঝিয়ে দেয়নি।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়ন করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমায় আগ্রহী না হওয়ার কারণ হিসেবে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের করদাতারা প্রযুক্তিবান্ধব নয় এবং অনেকের করভীতি আছে। করদাতারা অনলাইনে তথ্য প্রদানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ করদাতা হাতে–কলমে রিটার্ন প্রস্তুত করে আসছেন। তাঁদের অনলাইনে আনাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক করদাতার অনলাইনে কর পরিশোধে ভীতি আছে। তাঁরা ই-পেমেন্টে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অনলাইন রিটার্ন কীভাবে জমা দিতে হয়, এসব বিষয়ে এনবিআরের প্রচার-প্রচারণারও অভাব ছিল। ফলে করদাতাদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

অভিনব উপায়
অনলাইনে রিটার্ন জমায় করদাতাদের আগ্রহ বাড়াতে অভিনব কৌশল নেওয়া হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে নতুন কৌশল হিসেবে অনলাইনে রিটার্ন জমা দিলে ২ হাজার টাকা করছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যা একজন করদাতা একবারই পাবেন। এখন দেখার বিষয়, করদাতারা কতটা উৎসাহিত হন।

এদিকে এনবিআর অনলাইন রিটার্ন জমায় করদাতাদের আগ্রহ বাড়াতে গত ১৬ জুলাই সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে। সংস্থার সদস্য হাফিজ আহমেদ মুর্শেদ কমিটির প্রধান। চলতি আগস্ট মাসের মধ্যে করদাতাদের আগ্রহ বাড়াতে কী কী করা উচিত, সেই সুপারিশ করবে ওই কমিটি।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, মূলত করদাতাদের মধ্যে অনলাইনে রিটার্ন জমায় আগ্রহ বাড়াতে রেডিও-টিভিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হবে। এ ছাড়া ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হবে। অন্যদিকে মাঠপর্যায়ের কর কার্যালয়ের উদ্যোগে করদাতাদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভাও করা হবে।