TAXNEWSBD
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি বেড়েছে ২৬২০০ কোটি
সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৩:৪০ পূর্বাহ্ন
TAXNEWSBD

TAXNEWSBD

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে এগুলো আদায় অযোগ্য কুঋণে পরিণত হওয়ায় এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে ঋণের দ্বিগুণ অর্থ আটকে আছে। এছাড়া জালিয়াতির মামলা পরিচালনা ও জামানত রক্ষণাবেক্ষণে ব্যাংকগুলোকে আরও অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। সব মিলে জালিয়াতির বোঝা এখনো ব্যাংকগুলোকে বহন করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় হাজার কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ১২টি ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে হলমার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, অ্যানন টেক্স গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, সিটিসেল, সানমুন গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ এবং পিকে হালদার। এ ছাড়াও ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে দুটি। এর মধ্যে রয়েছে বেসিক ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংক। এর মাধ্যমে জালিয়াতি চক্রটি প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে। খেলাপি হয়েছে ২৬ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ওই ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত তা সামান্য কমে ৯৮ হাজার ২০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে বড় বড় জালিয়াতির কারণেই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বড় অঙ্কের জালিয়াতি রোধ করতে হবে। একটি বড় অঙ্কের জালিয়াতির কারণে খেলাপি ঋণ ১ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতি ঠেকানো এবং বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি হওয়া ঠেকানো গেলে ঋণখেলাপি বাড়ার প্রবণতা কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, এজন্য ব্যাংকগুলোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, নতুন ঋণ যাতে খেলাপি না হয় এবং আগের খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি নিয়মিত তদারকি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন ব্যাংকগুলোর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বৈঠক করে নানা নির্দেশনা দিচ্ছে।
হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকসহ ২৬টি ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। পুরো ঋণই এখন খেলাপি। এর মধ্যে তারা যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংকের মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড থেকে ৬৫ কোটি টাকার একটি এলসির দেনা শোধের নামে পাচার করেছে। জালিয়াতির তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর সোনালী ব্যাংকের কাছ থেকে ৫৬৭ টাকা আদায় করেছে। এরপর গত ১১ বছরে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি। প্রতিমাসে ১০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের শর্তে ২০১৩ সালে হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামের জামিন হয়েছিল। কিন্তু কোনো অর্থ পরিশোধ করতে পারেননি বলে তার জামিন বাতিল হয়ে যায়। এদিকে হলমার্কের সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকাও আদায় করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত মামলা করেছে।
সরকারি একটি ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি করেছে। এ ছাড়াও তাদের সরকারি বিকল্প নগদ সহায়তাসহ পরোক্ষ ঋণ রয়েছে। পুরো টাকাই এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। একই ব্যাংক থেকে অ্যানন টেক্স গ্রুপ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে গ্রুপটি প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কিছু ঋণ বিশেষ সুবিধায় নিয়মিত করার উদ্যোগ নিয়েছিল গ্রুপটি। কিন্তু জালিয়াতির ঋণ বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করার সুযোগ নেই বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নবায়ন প্রস্তাবটি বাতিল করে দিয়েছে।
ব্যাংকটির ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ১১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। বড় কয়েকটি গ্রুপ খেলাপি হওয়ায় তাদের এ ঋণ বেড়েছে। যে কারণে ব্যাংকটি বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে অবশ্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে বর্তমানে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বিসমিল্লাহ গ্রুপ ২০১৩ সালে ৫টি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পুরো অর্থই বিদেশ পাচার করে দেয়। এখন পুরো অংশই খেলাপি হয়ে গেছে।
এসএ গ্রুপ ১৬টি ব্যাংক থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা খেলাপি। একটি সরকারি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখা ও মহিলা শাখায় জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া ঋণের প্রায় ৮০০ কোটি টাকা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এবি ব্যাংকের গ্যারান্টিতে বেসরকারি খাতের ১২টি ব্যাংক থেকে সিটিসেল ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণের পুরোটাই এখন খেলাপি।
একটি সরকারি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে সানমুন গ্রুপ ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যার পুরোটাই এখন খেলাপি।
চট্টগ্রামের নূরজাহান গ্রুপ ২২টি ব্যাংক থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যার মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকা খেলাপি। কিছু ঋণ নবায়ন করা হয়েছে।
বেসিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকাই খেলাপি। বাকি টাকার কিছু অংশ নবায়ন করা হয়েছে। তাদের মোট খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালকরা ৫০০ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। ওইসব ঋণ এখন খেলাপি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে জাল-জালিয়াতির প্রবণতা কমাতে হলে বড় অঙ্কের ঋণের ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। এসব ঋণ যাতে খেলাপি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। কেননা একটি প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হলে এর বহুবিদ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যাংকের ওপর। ঋণটি যদি একক কোনো ব্যাংকের হয়, তবে ওই ব্যাংকটি বিপাকে পড়ে। তাদের খেলাপি ঋণ বহুলাংশে বেড়ে যায়। নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো ব্যাংকিং খাতের ওপর।
এদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ায় তাদের প্রভিশন সংরক্ষণের হার বেড়ে যাচ্ছে। অনেক ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। একই সঙ্গে বাড়ছে মূলধন ঘাটতি। এতে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর সার্বিক দুর্বলতা বেড়েছে।