TAXNEWSBD
ইস্পাহানি গ্রুপ ইস্পাহানি পরিবারের সাফল্যের ২০২ বছর
মঙ্গলবার, ১১ জানুয়ারী ২০২২ ০১:৩৮ পূর্বাহ্ন
TAXNEWSBD

TAXNEWSBD

ইস্পাহানি গ্রুপ ইরানের ইস্পাহান থেকে ভারতের বিভিন্ন শহর ঘুরে ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসা নোঙর করে চট্টগ্রামে। সেটি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে। শুরুতে কলকাতা ও চট্টগ্রাম উভয় স্থানে সমানতালে ব্যবসা চলছিল। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ভারত ইস্পাহানি পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে ইস্পাহানির ব্যবসা কেন্দ্রীভূত হয় বাংলাদেশে। ১৮২০ সালে শুরু হয়েছিল এ পরিবারের ব্যবসা।
ইস্পাহানি বড় পরিসরে চট্টগ্রামে ব্যবসা সম্প্রসারণে যাচ্ছে। পাশাপাশি ইস্পাহানি পরিবার নিজেদের থাকার জন্য আসকারদীঘির পাড়ে বিশপ হাউস কিনেছে। শহরের নানা জায়গায় তারা জমি কিনছে।

ইস্পাহানির ব্যবসায়িক সাফল্যের গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের ব্যবসায়িক ঐতিহ্যও। বিশ্বে এমন গল্প খুব কমই আছে। বিশ্বজুড়ে ৬০টি দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা এখনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ এশিয়া মহাদেশের সাতটি দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসফাহান শহর থেকে ব্রিটিশশাসিত ভারতের মুম্বাই শহরে এসে ব্যবসা শুরু করেন হাজি মোহাম্মদ হাশিম। তাঁর হাত ধরেই ২০২ বছর আগে এ অঞ্চলে ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসার শুরু। সময়ের সঙ্গে ধাপে ধাপে মোহাম্মদ হাশিম ও তাঁর উত্তরসূরিরা লন্ডন,মিসর, রেঙ্গুন, ভারতের চেন্নাই ও কলকাতা ঘুরে ঢাকা এবং সর্বশেষ চট্টগ্রামে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন।

দেশভাগের আগে চা-পাটের ব্যবসা ছাড়াও বিমান পরিবহন, ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছিল গ্রুপটি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের বছরে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন মির্জা সালমান ইস্পাহানির দাদা মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি (এম এ ইস্পাহানি)। হাজি মোহাম্মদ হাশিমের উত্তরসূরিদের অনেকে পরে ব্যবসা বা চাকরি নিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত ও পাকিস্তানে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছেন। তবে কলকাতা থেকে আসা উত্তরসূরিরা ইস্পাহানির ব্যবসায়িক কার্যক্রমের পরিধি বাড়িয়ে চলেছেন বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে ইস্পাহানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানির দাদা এম এ ইস্পাহানি। সে সময় চট্টগ্রামে একের পর এক কারখানা গড়ে ওঠে তাঁর হাত ধরে। দেশভাগের পর কলকাতার ভিক্টোরি জুট মিলের যন্ত্রপাতি খুলে এনে চট্টগ্রামের কাট্টলীতে একই নামে পাটকল স্থাপন করেন তিনি। এরপর ১৯৫০ সালে কালুরঘাটে স্থাপন করা হয় চিটাগাং জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৫৪ সালে পাহাড়তলীতে পাহাড়তলী টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিল নামে বস্ত্রকল গড়ে তুলে ইস্পাহানি। চট্টগ্রামকে এগিয়ে নিতে একই সময়ে ইস্টার্ন ফেডারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানিটির সদর দপ্তর কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করেছিলেন এম এ ইস্পাহানি। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিপিং ব্যবসায়ও যুক্ত হয় গ্রুপটি। বাংলাদেশে ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল রয়েছে ইস্পাহানি পরিবারের। চট্টগ্রামে ইস্পাহানির প্রধান কার্যালয় স্থাপনের পরই খুব দ্রুত একের পর এক কারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বড় শিল্প গ্রুপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পরিবারটি। রুশ অর্থনীতিবিদ এস এস বারানভ পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য গ্রন্থে লিখেছেন, ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় পাটকল স্থাপনে যে কয়টি গ্রুপ ও পরিবার নেতৃত্ব দিয়েছিল, তার মধ্যে ইস্পাহানি পরিবার অন্যতম।

ইস্পাহানি গ্রুপের শুরুর দিকের ব্যবসা ছিল চা। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চা রপ্তানি করত তারা। চট্টগ্রাম এসে বিপণনের পাশাপাশি এম এম ইস্পাহানি গ্রুপ প্রথম চা উৎপাদনে যুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ইস্পাহানি গ্রুপের হাত ধরেই নেপচুন চা-বাগানের খাসজমিতে উৎপাদন শুরু হয়। এরপর একে একে মৌলভীবাজারের জেরিন চা-বাগান, গাজীপুর চা-বাগান এবং মির্জাপুর চা-বাগান ইস্পাহানি গ্রুপের হাতে আসে। সর্বশেষ ২০০৫ সালে ফিন্লের বাগানের শেয়ার কিনে চায়ের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে কোম্পানিটি।

২০২০ সালে ইস্পাহানির ৪টি বাগানে ৪৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। প্রায় ৭ হাজার ৮৮৫ একর আয়তনের ৪টি বাগানের উৎপাদন দিয়ে চতুর্থ অবস্থানে আছে কোম্পানিটি। একরপ্রতি উৎপাদনেও শীর্ষ তিন বাগানের একটি ইস্পাহানি। এ বছর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পরিবেশবান্ধব কারখানার পুরস্কার চালু করে। প্রথমবার চা-শিল্পে সেরা পরিবেশবান্ধব বাগান হিসেবে নির্বাচিত চারটি চা-বাগানের দুটিই ইস্পাহানির।

ইস্পাহানি গ্রুপের হাত ধরে ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর কলকাতায় ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড নামে পূর্ব বাংলায় প্রথম বেসরকারি খাতের উড়োজাহাজ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকার কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করে।

আবার কলকাতায় মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি। দেশভাগের আগে ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডারও ছিলেন তিনি।

পুরোনো অনেক ব্যবসা ধরে রাখার পাশাপাশি ইস্পাহানি গ্রুপ নতুন নতুন ব্যবসায়ও যুক্ত হয়েছে। চা বিপণন ও উৎপাদন, টেক্সটাইল, আবাসন, খাদ্যপণ্য, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, কনটেইনার ডিপো, প্যাকেজিং, জুট বেলিং, সিকিউরিটিজ এবং পর্যটন খাতে ব্যবসা রয়েছে এখন গ্রুপটির। গ্রুপটির অধীনে রয়েছে ১৮টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।

আবাসন খাতেও দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প আছে ইস্পাহানির। ঢাকার মগবাজারে ইস্পাহানি কলোনিতে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে ৪৫৭ অ্যাপার্টমেন্টের কনডোমিনিয়াম প্রকল্প গড়ে তুলছে ইস্পাহানি গ্রুপ। দুই দশক আগে খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপ।

পুরোনো পাটকল ছেড়ে এখন টেক্সটাইল খাতেও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে ইস্পাহানি। কয়েক বছর আগে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে পাহাড়তলী টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিলস কারখানা সম্প্রসারণ করেছে গ্রুপটি। তাতে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক লেনদেন বেড়ে ৬০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।

২০১৮ সালে চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীতে ভিক্টোরি জুট মিলের জায়গায় সামিট গ্রুপ ও অ্যালায়েন্স হোল্ডিংস লিমিটেডের সঙ্গে মিলে কনটেইনার ডিপো গড়ে তুলেছে। প্রায় ১৩০ কোটি টাকায় এখন গাজীপুরে চায়ের অত্যাধুনিক কারখানা গড়ে তুলছে গ্রুপটি। ঢাকা ও খুলনায় পর্যটন ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিকল্পনাও প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে গ্রুপটি।

ইস্পাহানি পরিবার বিনা খরচে শ্রমিক ও মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে গ্রুপটি। করোনার সময় ইস্পাহানির কর্মীদের পদোন্নতি বা সুযোগ-সুবিধা কিছুই কাটছাঁট হয়নি। চাকরিও যায়নি কারও।

বিশ্বের অনেক দেশ-শহরে ব্যবসার প্রসার ঘটালেও ৭৫ বছর আগে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশকে প্রধান কার্যালয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল ইস্পাহানি। সততা-নৈতিকতা মেনে যে ব্যবসা করা যায়, তারও পথ দেখিয়েছে গ্রুপটি। বাংলাদেশি ব্র্যান্ডকে বিশ্বে পরিচিত করেছে। ২০২ বছরের পারিবারিক ব্যবসা শুধু ইস্পাহানির নয়, এ দেশের জন্যও গৌরবের। ২০২ বছরের ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসার ইতিহাসে এ বছর চট্টগ্রামে ব্যবসার প্লাটিনাম জয়ন্তী পূর্তি হচ্ছে ইস্পাহানি পরিবারে।