দশ পণ্যে রাজস্ব আহরণে ধসআমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের শুল্ককর যৌক্তিক হতে হবেমেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চায় আইপিডিস্বর্ণালংকারে ভ্যাট কমানোর দাবি বাজুসেরসিগারেটে কর বাড়ানোর আহ্বান এমপিদের
No icon

সব শ্রেণির মানুষকে মাথায় রেখে বাজেট করছি : অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এক দিন পরেই ২০২১-২২ অর্থবছরের নতুন বাজেট পেশ করবেন। এটি তাঁর উপস্থাপিত তৃতীয় বাজেট। আগামী অর্থবছরের বাজেট এবং দেশের অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। টেলিফোনে কথা বলার পাশাপাশি লিখিত প্রশ্নেরও জবাব দেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফখরুল ইসলাম।
প্রথম আলো: একটি করে অর্থবছর যাচ্ছে, আর টাকার অঙ্কে বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। দরকার ছিল বাজেটে গুণগত পরিবর্তন আনা। সেটা কি খুব কঠিন? 

আ হ ম মুস্তফা কামাল: গুণগত পরিবর্তন দেখতে পাবেন। আগামী অর্থবছর থেকে তা আরও বেশি দেখতে পাবেন। গেল ২০২০ সাল আমাদের জাতীয় জীবনে ছিল এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করছি, যা এ বছর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকবে। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান যুগপৎভাবে চলছে। এই বিশেষ বছরে আমরা আত্মপ্রত্যয়ী ছিলাম অর্থনীতিতে দেশের সেরা প্রবৃদ্ধিটি জাতিকে উপহার দেব। এ ক্ষেত্রে আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। সে অনুযায়ী আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী গতানুগতিক বাজেটের বাইরে গিয়ে বাজেট দিয়েছি, যা শুধু আকারে বড় নয়, গুণগত মানেও অন্যান্য বছরের তুলনায় ভিন্ন। কিন্তু কোভিড-১৯–এর প্রভাবে সব পাল্টে গেল। তবে এই কোভিডকেও যথাসাধ্য মোকাবিলা করছি আমরা।

চলতি বাজেটেই কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজসহ করণীয় সব বিষয় এনেছি। আমাদের সংস্কার কার্যক্রমসমূহও সংযুক্ত করেছি। একই সঙ্গে আগের অর্থবছর আমাদের গৃহীত সংস্কার পদক্ষেপসমূহের অগ্রগতিও জনগণের সামনে তুলে ধরেছি। গত দুটি বছর বাজেটের গুণগত পরিবর্তন যেমনটি আমরা মনে করি করা প্রয়োজন ছিল, তা অনেকাংশেই এসেছে। আগামী বাজেটে গুণগত পরিবর্তন আরও বেশি করে আসবে।
প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ প্রণোদনা, তৈরি পোশাকের সব খাতে নগদ প্রণোদনা সহায়তা, খেলাপি ঋণ কমানো ইত্যাদি হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক, আর্থিক, রাজস্ব খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে একাধিক আইন সংশোধন করা হচ্ছে। নতুন আইন প্রণয়নও হচ্ছে। ৯ শতাংশের নিচে সুদহার এখন বাস্তবতা। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র ডিজিটালাইজেশন, আর্থিক খাতের জন্য উচ্চ আদালতে পৃথক বেঞ্চ গঠন, রাজস্ব খাতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় নিয়ে আসা ইত্যাদি অনেক পদক্ষেপই বাজেটের গুণগত মান বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশের অবস্থান লজ্জাজনক—এমন বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। এটা সত্য, কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ পিছিয়ে। কিন্তু এর জন্য সরকার কখনো কোনো অজুহাত দেখায় না। কর-জিডিপি অনুপাতে পেছনে থাকার একটা বড় কারণও আছে। অনেকেই এটা বলেন না। বাংলাদেশের মতো এত বিশাল পরিমাণ রাজস্ব ছাড় অন্য কোনো প্রতিবেশী দেশে দেয় না। আমাদের সব বৃহৎ, ফাস্ট ট্র্যাক ও অধিকাংশ বড় প্রকল্পের জন্য কেনা পণ্যে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ও ভ্যাট মওকুফ করা হয়। সরকারি এক হিসাব আরেক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর না করার কারণেও অনাদায়ি কর থাকে, যার হিসাব নেওয়া হয় না। এ ছাড়া দেশীয় অনেক শিল্প রক্ষার্থে বড় অঙ্কের রাজস্ব ছাড় দেওয়া হয়। আমাদের এসব অনাদায়ি রাজস্ব আমরা আদায় করলে আমাদের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত প্রকৃত হিসাবে এখন ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হতো। এটাও মনে রাখা উচিত ২০০৬-০৭ সালে এ অনুপাত ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে করোনার আগের ১০ অর্থবছরে আমাদের রাজস্ব আদায়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। যেখানে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।
 কর-জিডিপি হার বাড়াতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে বিশেষ নজর দিয়েছি। কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও গতিশীলতা আনতে আমরা শুল্ক ও কর রাজস্ব খাতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। ২০১৯ থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করে আসছি। অনলাইন ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন ও অনলাইন ভ্যাট রিটার্ন দাখিল ব্যবস্থা চালুর পর গত বছরের জুলাই থেকে ইলেকট্রনিক পেমেন্ট বা ই-পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট ফাঁকি রোধে এবং ভ্যাট আহরণ বৃদ্ধির জন্য ৫ লাখ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বা ইএফডি মেশিন স্থাপনে কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া অচিরেই জাতীয় সংসদে নতুন কাস্টমস আইন পাস হবে। এটি হলে শুল্ক আহরণে গতি সঞ্চার হবে। আরও যেসব সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে কর-জিডিপি অনুপাত আরও বাড়বে বলে আমি আশাবাদী।

কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে পরিকল্পনা মোতাবেক ২০২০ সালে প্রথমার্ধে দেশব্যাপী ইএফডি মেশিন স্থাপন করা যায়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ২৪টি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সুপারশপ, মিষ্টান্ন ভান্ডার, বেকারি ও ফাস্ট ফুডের দোকান, আবাসিক হোটেল, ডেকোরেটরস এবং ক্যাটারার ইত্যাদি। দেশব্যাপী ১০ হাজার ইএফডি মেশিন স্থাপনের কাজ চলছে।

ব্যাংকের মালিকানা তুলে দেওয়া সরকারের কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে মালিকানা হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। কেনাবেচা বা অধিগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পূর্ণভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিষয়।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশ রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। কারণ, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশি পণ্য বর্তমানে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) এবং শুল্ক ও কোটামুক্ত কর্মসূচির আওতায় অধিকাংশ উন্নত দেশ এবং কিছুসংখ্যক উন্নয়নশীল দেশের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশি পণ্য আর এ সুবিধা ভোগ করবে না। সে কারণে ওই তালিকা থেকে বের হওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত (যা অন্যূন ৫ বছর হতে পারে) যাতে ওই বাজারসমূহে আমাদের পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত থাকে, সে লক্ষ্যে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

 বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইদের পাঠানো অর্থ। তাঁরা আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম কান্ডারি। দেশের প্রতি তাঁদের মমত্ববোধ অপরিসীম। জাতির কাছে তাঁরা দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব। আমার এই বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাবেন বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও তাঁদের পাঠানো অর্থ প্রতি মাসে বেড়েই চলেছে। প্রতি মাসে রেকর্ড গড়ে চলেছেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিয়ে আসছি। এর সুফল এখন আমরা পেতে শুরু করেছি। প্রবাসী ভাই-বোনেরা বুঝতে পেরেছেন অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠালে তাঁদের টাকা হারানোর ঝুঁকি বেশি। অন্যদিকে বৈধ পথে টাকা পাঠালে তাঁদের আত্মীয়স্বজন কিছু বেশি টাকা পাবেন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, অক্টোবর ২০২০ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসজনিত মহামারির কারণে বৈশ্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি বিষয়ে আগের প্রাক্কলন (এপ্রিল ২০২০) ৫ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে সংশোধন করে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আইএমএফের প্রাক্কলন অনুসারে ২০২১ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। আমি তাঁদের সঙ্গে অনেকটাই একমত। কেননা চীন, ভারতসহ উন্নত বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোয় ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কয়েকটি কোভিড-১৯ প্রতিরোধক টিকার ব্যবহার শুরু হয়েছে। ফলে করোনার প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এনে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনা যাবে। আমি আশাবাদী, অচিরেই ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনীতির চাকা আগের মতো ঘুরতে শুরু করবে। চীনের মতো ভারতও পূর্ণোদ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করছে।

আর বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সাময়িক অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিবিএসের সাময়িক হিসাব অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির কারণে কোভিড-১৯ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করতে পেরেছি।

এ ছাড়া মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন, প্রবাসী আয়, রপ্তানি ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানি কনটেইনার চলাচলের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিও আশাব্যঞ্জক। এসব চিত্র থেকে প্রতীয়মান হয়, অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটতে শুরু করেছে।

আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক এলাকাগুলোর প্রায় সবটাই মূল অর্থনীতির স্রোতোধারায় নিয়ে আসতে পেরেছি। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন। আগামী অর্থবছরেও প্যাকেজ বাস্তবায়নে আমাদের তদারকি ও মনোযোগ থাকবে। মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির সব এলাকায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ক্রমেই আমাদের অর্থনীতির অবস্থা আগের প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসছে। এ কারণে আমি মনে করি সামনের দিনগুলোয় আমাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ আসতে পারে বহিঃখাত থেকে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয় আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা অব্যাহত থাকলে তা আমাদের জন্যও ক্ষতিকর। প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে মহামারিজনিত মন্দা অব্যাহত থাকলে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাহত হবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্থিতিশীল হয়ে পড়াটা হবে বড় সমস্যা। আরেক বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রধান শ্রমবাজারগুলোতে শ্রমিক পাঠানো ব্যাহত হওয়া বা বন্ধ থাকা। এ বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়েই দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাজেট সাজিয়েছি আগামী অর্থবছরের জন্য।

সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে মাথায় রেখে বাজেট করছি।