বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রধান দুই বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রায় ৩৫ শতাংশ মূলত এই দুই দেশেই যায়। কিন্তু চলতি বছরে এই দুই বাজারে আশঙ্কাজনকভাবে পোশাক রপ্তানি কমেছে। বহির্বিশ্বে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে যখন পোশাক রপ্তানি ৭.২৭ শতাংশ বেড়েছে, সে সময় বাংলাদেশি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি কমেছে ১১৭ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা ১২ হাজার ৬২৪ কোটি টাকার (রপ্তানিতে ডলার রেট ১০৭ টাকা ৫০ পয়সা ধরে)।
প্রবৃদ্ধি কমেছে ১০.৫৮ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওটেক্সা, ইউরোপের ইউরোস্ট্যাট ও ইপিবি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গার্মেন্টসসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আপাতত নন-ট্র্যাডিশনাল বা অপ্রচলিত বাজার দিয়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তুলে রাখা গেলেও প্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি তাঁদের ভাবিয়ে তুলছে। এসব বাজারে রপ্তানি অর্ডার কমার কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে এখনই সচেতন না হলে ভবিষ্যতে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যটিকে ভুগতে হবে।
বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানি
বাংলাদেশ রপ্তানি ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৫০ গন্তব্যে তিন হাজার ১৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের ২০২২ সালে রপ্তানি হওয়া দুই হাজার ৯৮২ কোটি ৫১ লাখ ডলার থেকে ৭.২৭ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। মোট রপ্তানির ৪৯.৬০ শতাংশ বা এক হাজার ৫৮৬ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের পণ্য গেছে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে। এর পরেই একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি ৫৭০ কোটি ডলারের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে ৩৬০ কোটি ৭৩ লাখ ডলার এবং কানাডায় ১০১ কোটি ৫১ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। আর নন-ট্র্যাডিশনাল বা অপ্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫৮০ কোটি ২৩ লাখ ডলার।
বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেমন করছে
গত ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে চার হাজার ৫৭০ কোটি ৯১ লাখ মার্কিন ডলারের গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে বহির্বিশ্বে। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ৬৩৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৩৫.৭৬ শতাংশ। তবে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রধান দুই রপ্তানি গন্তব্যে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৯৯২ কোটি ২৯ লাখ ডলার, যা এই সময়ে মোট রপ্তানির ৩১ শতাংশ।
অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি ও হিস্যা দুই-ই কমেছে। আগস্ট পর্যন্ত গত আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আগের বছরের চেয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫০ কোটি ডলার বা ৮.০৮ শতাংশ। জার্মানিতে পরিস্থিতি আরো নাজুক। এই বাজারে কমেছে ৬৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৩.৭৫ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওটেক্সা ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাপারেল আমদানির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক আমদানি কমেছে এক হাজার ৩১০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২.২৮ শতাংশ কম। এর প্রভাব পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পোশাক রপ্তানিকারক চীনের প্রবৃদ্ধিতে। দেশটি থেকে তৈরি পোশাক আমদানি কমেছে ২৮.৭৫ শতাংশ। ভিয়েতনাম থেকে কমেছে ২৪.৭৬ শতাংশ। আর ওটেক্সার তথ্য অনুযায়ী, জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি কমেছে ১৯.৮২ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি কম হওয়া প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ‘মূল কারণ যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক মন্দা। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, নিত্যপণ্যের দাম সেখানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সেখানকার মানুষ এখন বিলাসপণ্যের চেয়ে খাদ্য ও মৌলিক চাহিদা মেটাতে অর্থ ব্যয় করছে। স্বাভাবিকভাবে চাহিদা না থাকলে অর্ডারও কমবে, এটাই সহজ সমীকরণ।’
তিনি বলেন, ‘আমার নিজের যে আইটেম আগে এক মিলিয়ন পিস অর্ডার হতো, সেটা এখন চার থেকে পাঁচ লাখ পিসে নেমে এসেছে। কভিড আমাদের ক্ষতি করতে পারেনি, উল্টো প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। অথচ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আমাদের ভীষণভাবে ভোগাচ্ছে।’
ইউরোপভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইউরোস্ট্যাট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চলতি বছরে জার্মানি তৈরি পোশাক আমদানি করেছে এক হাজার ৩২২ কোটি ৬১ লাখ ডলার। আমদানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ০.০৪ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আমদানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ৩১১ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি কমেছে ৮.৯৬ শতাংশ। অথচ একই সময়ে প্রতিযোগী চীন থেকে পোশাক আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৭৮ শতাংশ, তুরস্ক ও ভিয়েতনামে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ০.৭০ ও ৪.৭৭ শতাংশ।
জার্মানিতে অন্যদের প্রবৃদ্ধির সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি কমার কারণ ভিন্ন বলে মনে করেন প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেখানকার বায়াররা স্বল্প লিডটাইম অর্ডারের দিকে ঝুঁকছে। কাছাকাছি দেশ তুরস্ক কিংবা কম সময়ে পণ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তায় ভিয়েতনামে অর্ডার করছে। কাছের দেশ থেকে স্বল্প সময়ে পণ্য নেওয়ার সুবিধা হচ্ছে, বায়ার বিক্রি দেখে চাহিদা বুঝে অর্ডার করতে পারে।’
ভারসাম্য ধরে রেখেছে অপ্রচলিত বাজার
তৈরি পোশাকের প্রধান দুই রপ্তানি বাজারে প্রবৃদ্ধি কমলেও গত আট মাসে বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.২৭ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধিতে মূল প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে নন-ট্র্যাডিশনাল বা অপ্রচলিত বাজার। প্রচলিত বাজারে যেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.৫০ শতাংশ, সেখানে বিকল্প বা অপ্রচলিত বাজারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮.৩১ শতাংশ, যা মোট রপ্তানি হিস্যার ১৮.১৪ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানিতে অপ্রচলিত বাজারের হিস্যা ছিল ১৫.১৬ শতাংশ।
মূলত জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্কের মতো দেশগুলোতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অপ্রচলিত বাজারে পণ্যের রপ্তানি বাড়ার প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও ইস্টার্ন অ্যাপারেলস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাছির উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মন্দা সময়ে আমরা কারখানার ক্যাপাসিটি ফেলে রাখতে পারি না। এ ছাড়া প্রণোদনার মতো সরকারি কিছু পদক্ষেপে উদ্যোক্তারাও এখন বিকল্প বাজারে ঝুঁকছে। কারণ এই বাজারে এখনো যুদ্ধের প্রভাব পড়েনি। এ কারণে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ছে।’