অবৈধ উপায়ে অর্জিত ও অপ্রদর্শিত আয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত না হয়ে বিদেশ চলে যাওয়ায় (মানিলন্ডারিং) ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা হারানোসহ নানাভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ প্রবণতা বেড়েই চলছে; কিন্তু অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর ধরে এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ চলে; কিন্তু শেষ হয় না। এক্ষেত্রে বড় বাধা সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য প্রদানে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নেওয়া। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক প্রতিবেদনে এ বাধার কথা জানিয়েছে। এতে মানিলন্ডারিং মামলার তদন্তকাজে মোট ৯টি প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলার তদন্তে এনবিআরের পিছিয়ে পড়ার চিত্রও উঠে এসেছে।সম্প্রতি মানিলন্ডারিং তদন্ত এবং মানিলন্ডারিং অনুসন্ধান কার্যক্রমের অর্জিত অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা প্রতিবেদন শীর্ষক একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে জমা দেয় এনবিআর। এতে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধের অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনস্থ দপ্তরগুলোর কার্যক্রম এবং পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) আইন, ২০১৫-এর আলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ কাস্টমস মানিলন্ডারিং তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য ক্ষমতা পায়। এর পর থেকে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত ১০৭টি মামলা দায়ের করে এনবিআরের অধীনস্থ দপ্তরগুলো। এর মধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ঢাকার ৯৫টি মামলার মধ্যে তদন্ত চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে ২০টি মামলা। এগুলোর মধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়েছে ১৫টির এবং ৫টির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে। আর চলমান রয়েছে ৭৫টির। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ১১টি এবং সিআইসির ১টি মামলার কোনো অগ্রগতি নেই।মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) আইনে এ সংক্রান্ত তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা পাওয়ার প্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনস্থ বিভিন্ন দপ্তরে মানিলন্ডারিং তদন্ত ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে এক্ষেত্রে ৯টি সীমাবদ্ধতা দেখতে পেয়েছে এনবিআর।
প্রতিবেদনে মানিলন্ডারিং অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে প্রথমেই তথ্য প্রদানে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সময়ক্ষেপণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়, মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তদন্তের কার্যক্রমে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথ্য চাওয়ার পর দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। এ ছাড়া মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তদন্তের আইনানুগ ও দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দপ্তরগুলোর নিজস্ব আইনি সেল না থাকায় সংশ্লিষ্টদের কাজে বেগ পেতে হয়। এ ছাড়া এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তদন্তের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সরকারি চাকরি বিধিমালার আলোকে নিয়মিত বদলির কারণে অনুসন্ধান ও তদন্তের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। মানিলন্ডারিং মামলায় আসামি গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো কাস্টডিয়ান সেল না থাকা আরেকটি সমস্যা। মামলা পরিচালনার জন্য সঠিক আইনি পরামর্শ গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট পরামর্শক না থাকাও বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি করে।সীমাবদ্ধতাগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে- মামলার পক্ষে আদালতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নির্দিষ্ট সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) না থাকা। এতে মামলার কাজ ব্যাহত হয়। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তার স্বল্পতা এবং অনুসন্ধান ও তদন্তের কার্যক্রমে প্রয়োগের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। আরেকটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তদন্তকাজে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা। এ ছাড়া অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমে পর্যাপ্ত তহবিলের অভাব রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ প্রতিরোধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরগুলোকে সমন্বিত পদক্ষপ গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের জন্য অভিন্ন বিধি জারি করা যেতে পারে।এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা এলে তদন্ত আটকে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আর তদন্ত আটকে গেলে মামলা নিষ্পত্তি হবে না। তাই তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যদিও অনেক সময় রিপোর্ট দেওয়ার পরও মামলা নিষ্পত্তি হয় না। তিনি আরও বলেন, এখানে দেখতে হবে কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আসলেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব কি না। ছোটদের বিরুদ্ধে যেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ, বড়দের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া।