চলতি অর্থবছর ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সামনে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আহরণের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে সাময়িক হিসাবে সংস্থাটি আহরণ করেছে ১ লাখ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ফলে প্রথম ছয় মাসে এনবিআরের রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে রাজস্ব আহরণে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে আমদানি-রফতানি পর্যায়ে শুল্ক খাত। কয়েক বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে খাতটি ভালো করলেও এবার নির্বাচনের কারণে শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছে। মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানি কমে যাওয়ায় ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব পেয়েছে কাস্টম হাউজগুলো। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৪১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে শুল্ক বাবদ রাজস্ব এসেছে ৩৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করে দেশের বৃহৎ একটি কাস্টম হাউজের কমিশনার বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম থেকেই মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানি কমে যায়। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চিনি, গুঁড়ো দুধ, সয়াবিন তেল, সিমেন্টের কাঁচামাল (ক্লিংকার), ওষুধের কাঁচামাল, আপেল, কমলাসহ বেশকিছু পণ্যের আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি নির্বাচনের বছর হওয়ায় চলতি বছরের বাজেটে অনেক পণ্যে শুল্ক ছাড় দেয়ায় আদায় কমে গেছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি কমিশনারেটগুলো।
কয়েক বছর ধরেই রাজস্ব আহরণে সবচেয়ে বড় খাত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে প্রায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এনবিআর। তবে প্রথম ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে খাতটি। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মাত্র ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ৪০ হাজার ১৭০ কোটি টাকার রাজস্ব এসেছে ভ্যাট থেকে। আলোচ্য সময়ে ৫০ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এ রাজস্ব পেয়েছে এনবিআর। এ হিসাবে ঘাটতি রয়েছে ১০ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। নির্বাচনের কারণে চলতি অর্থবছর মাঠপর্যায়ে রাজস্ব অভিযান বন্ধ থাকায় বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভ্যাট-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন সদস্য বলেন, ভ্যাট খাতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে আগের ম্যানুয়াল পদ্ধতির পাশাপাশি ভ্যাট অনলাইন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকি রোধে দোকানে দোকানে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) ও ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এক লাখ ইএফডি আমদানি করা হয়েছে। এখন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে ভ্যাট বিভাগ।
লক্ষ্য অর্জনে মূসক ও শুল্ক খাত বেশ পিছিয়ে থাকলেও কিছুটা ভালো করেছে আয়কর। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ৩৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয়কর ও ভ্রমণ কর মিলে এ খাত থেকে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। প্রথম ছয় মাসে খাতটিতে রাজস্ব আহরণে প্রায় ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছর শেষে আয়কর খাতে লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি পূরণ হবে বলে জানিয়েছেন এ খাতের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে রাজস্ব কর্মকর্তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। প্রথমার্ধে আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় শুল্ক আহরণ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী করতে পারেনি কাস্টম হাউজগুলো। ভোটের কারণে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আহরণে মাঠপর্যায়ে বড় তদারকি বন্ধ ছিল। ফলে এ বিভাগে রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে আসেনি। এখন কর্মকর্তাদের নতুন করে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব বলে আমরা আশাবাদী।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। যদিও বিগত পাঁচ বছরে রাজস্ব আহরণের গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ১২ শতাংশ। অর্থবছরের শেষ দিকে রাজস্ব আহরণের গতি বাড়লেও এত বড় ঘাটতি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছা সম্ভব বলে মনে করছেন এনবিআরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার এনবিআরের সম্মেলন কক্ষে মাসিক সভায় রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে মাঠ কর্মকর্তারা বছর শেষে ভালো করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, রাজস্ব খাতে বড় সংস্কার না আনলেও ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে চলতি অর্থবছর এনবিআরের জন্য ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাটে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আয়করে ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ১ লাখ ২ হাজার কোটি ও শুল্কে আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে এনবিআরকে। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও আদায় বাড়িয়ে অর্থবছর শেষে ৩ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব জমা দিতে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দিয়েছেন নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।