TAXNEWSBD
মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিতে কর ফাঁকির অভিনব কৌশল
রবিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০১৯ ১৪:৪১ অপরাহ্ন
TAXNEWSBD

TAXNEWSBD

বাংলাদেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানিতে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিনব পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এ পদ্ধতিতে তিনটি চীনা ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে গত এক বছরে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে কর ফাঁকির নতুন পদ্ধতির কারণে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে যাওয়া আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়ছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন শিল্প। বিটিআরসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তারাও কর ফাঁকির অভিনব পদ্ধতি সম্পর্কে অভিযোগ পেয়েছেন। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে পদ্ধতিতে কর ফাঁকি :এই অভিনব পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায় সম্প্রতি বিটিআরসিতে জমা পড়া একটি অভিযোগ থেকে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান বরাবর এ অভিযোগ দিয়েছে বাংলাদেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন ও আমদানিকারকদের সংগঠন বিএমপিআই।

ওই অভিযোগের সঙ্গে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ ও দলিল সংযুক্ত করে বলা হয়, বাংলাদেশে কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান অবৈধ কার্যকলাপের মাধ্যমে শুল্ক্ক ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোন আমদানি করছে। অভিযোগে সুনির্দিষ্টভাবে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশকরা মূল কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি আমদানি না করে অজানা তৃতীয় পক্ষের কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি করছে। অভিযোগে বলা হয়, মূল কোম্পানি অপো ইলেকট্রনিক করপোরেশন-এর কাছ থেকে আমদানি না করে সিনসিয়ার ওর্থ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অপো ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট আমদানি করছে অপো বাংলাদেশ। একইভাবে ভিভো বাংলাদেশ ভিভো টেকনোলজির পরিবর্তে কালার টাইফুন গ্লোবাল এবং হুয়াওয়ে ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট এডা হোল্ডিংস লিমিটেড, হংকং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মূল ওপো, ভিভো কিংবা হুয়াওয়ের সম্পর্ক নেই এবং এগুলোর আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরিচিতি কোনো স্বীকৃত মাধ্যমে পাওয়া যায় না। এই প্রতিষ্ঠানগুলো কেবলমাত্র বাংলাদেশেই তিনটি ব্র্যান্ডের পণ্য রফতানির জন্য খোলা হয়েছে।

এ অভিযোগের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, মূলত কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে অচেনা কোম্পানির নাম ব্যবহার করা হচ্ছে হ্যান্ডসেট আমদানির জন্য। এই তিনটি ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট আমদানির ক্ষেত্রেই কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সামনে প্রকৃত আমদানি মূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো হচ্ছে। কম মূল্য দেখিয়ে কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক খুচরো মূল্য হিসেবেই দাম নেওয়া হচ্ছে।

অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক সময়ে অপো ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট আমদানির তথ্য থেকে দেখা যায়, অপো এফ৯(৬/৬৪ জিবি) হ্যান্ডসেট আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার ১১১ টাকা ১০ পয়সা, অথচ এই হ্যান্ডসেটটির বাজারে খুচরো মূল্য ৩১ হাজার ৯৯০ টাকা। ফলে আমদানি মূল্য এবং খুচরো বিক্রয় মূল্যের মধ্যে পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ১৮৭ শতাংশ। কিন্তু সাধারণভাবে এ দুটি দামের পার্থক্য হওয়ার কথা ৬৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ। কারণ আমদানি মূল্যের সঙ্গে সরকারি শুল্ক্ক ও কর এবং বাজারজাতকরণে অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে আমদানি মূল্যের চেয়ে খুচরো মূল্য ৬৫ শতাংশ বেশি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক হিসেবে অপোর এই হ্যান্ডসেটটির আমদানি মূল্য হওয়ার কথা ছিল ২০ হাজার ৭৯৩ টাকা থেকে ২২ হাজার ৩৯৩ টাকার মধ্যে। কিন্তু আমদানি মূল্য ১৭ হাজার ১১১ টাকা দেখানোর ফলে প্রতি হ্যান্ডসেটে কমপক্ষে এক হাজার টাকার কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিভো ওয়াই৯ মডেলের হ্যান্ডসেট আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ১১ হাজার ১১১ টাকা ৪২ পয়সা, আর বাজারে খুচরো মূল্য ২২ হাজার ৯৯০ টাকা। অর্থাৎ, আমদানি মূল্য এবং খুচরো মূল্যের মধ্যে পার্থক্য ২২১ শতাংশ। অথচ খুচরো মূল্য অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে এই হ্যান্ডসেটের আমদানি মূল্য হওয়ার কথা ১৪ হাজার ৯৯৩ টাকা। এক্ষেত্রেও আমদানি মূল্য প্রায় চার হাজার টাকা কম দেখিয়ে এক হাজার টাকার বেশি কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

চীনা অপর ব্র্যান্ডের একটি মডেলের হ্যান্ডসেটের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ৩২ হাজার ৪৭৯ টাকা, অথচ বাজারে এর খুচরো মূল্য ৮৯ হাজার ৯৯০ টাকা, অর্থাৎ, আমদানি ও খুচরো মূল্যের পার্থক্য ২৭৭ শতাংশ!

অনুসন্ধানে দেখা যায়, তিনটি চীনা ব্র্যান্ডের গত বছরে প্রায় ১৩ লাখ হ্যান্ডসেট বাংলাদেশে এসেছে। প্রতি হ্যান্ডসেটে এক হাজার টাকা কর ফাঁকি দিলে বছরে কর ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৩০ কোটি টাকা।

দায় এড়ানোর কৌশল বিটিআরসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্যের স্থানীয় পরিবেশক নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো প্রতিষ্ঠান হতে পারে। কিন্তু পরিবেশক আমদানি করে সরাসরি মূল প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে, এটাই দীর্ঘদিনের রীতি। কিন্তু মূল প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে তৃতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে আমদানি করার বিষয়টি অস্বাভাবিক। এ কারণেই বিটিআরসি বিএমপিআইর অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধান করছে। এক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া গেলে অবশ্যই নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সংশ্নিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, মূল প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে এভাবে প্রকৃত আমদানি মূল্যের তথ্য গোপন করে কম মূল্য দেখানো যায় না। এ কারণেই কৌশল হিসেবে তৃতীয় আর একটি কোম্পানি খোলা হয়েছে যার আন্তর্জাতিক পরিচিতি নেই। কখনও এসব তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠানের কর ফাঁকির তথ্য প্রকাশ হলে তার দায় মূল প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়বে না। আসলে কর ফাঁকির দায় এড়ানোর জন্যই অস্বাভাবিকভাবে মূল প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে তৃতীয় পক্ষের প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খোলা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভারতে হ্যান্ডসেট আমদানির ক্ষেত্রে বন্দরেই শুল্ক্ক কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতি মডেলের হ্যান্ডসেটের খুচরা মূল্য উল্লেখ করতে হয়। কর্তৃপক্ষ খুচরা মূল্য থেকে আমদানিকারকদের অন্যান্য তথ্য মিলিয়ে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ বাদ দিয়ে প্রকৃত আমদানি মূল্য নির্ধারণ করে কর ধার্য করে। কিন্তু বাংলাদেশে আমদানি পর্যায়ে খুচরো মূল্য উল্লেখের বাধ্যবাধকতা নেই।

সংশ্নিষ্টদের বক্তব্য এ বিষয়ে জানতে চাইলে অপো বাংলাদেশের ইমপোর্ট ইনচার্জ (কমার্শিয়াল) মোহাম্মদ ইকবাল পাটোয়ারি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে অপো বাংলাদেশে অপো ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট বাজারজাত করছে। আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের সব নিয়ম-নীতি এবং প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, আমদানি সম্পর্কে কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে অপোর আমদানি প্রক্রিয়ার বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়। সেখানেও অপো স্বচ্ছতার সঙ্গে সব তথ্য দিয়েছে। অপো সম্পর্কে অন্যান্য কর্তৃপক্ষও তথ্য চাইলে তা দেওয়া হবে। আমদানি প্রক্রিয়ায় অপো সব সময়ই স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ করে।

এ ব্যাপারে ভিভো বাংলাদেশের কর্মকর্তা তানজীব আহমেদ বলেন, বৈধ এবং লাইসেন্সড অংশীদারের কাছ থেকেই ভিভো ব্র্যান্ডের হ্যান্ডসেট বাংলাদেশে আমদানি করা হচ্ছে। আমদানির ক্ষেত্রে ভিভো বাংলাদেশের স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়ম কঠোরভাবে অনুসরণ করে। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভিভো সর্বোচ্চ নীতি অনুসরণ করে গ্রাহককের কাছে সেরা পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বার বার যোগাযোগের পরও হুয়াওয়ের আমদাকিারক এডা ট্রেডিং, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।