গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল তারা নির্বাচিত হলে গ্রামের মানুষের কাছে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বর্তমান নতুন মেয়াদের প্রথম বাজেটেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে আগামী বাজেটকেই গ্রামবান্ধব করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে গ্রামীণ অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার, গ্রামের হাটবাজারগুলোকে অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে গ্রামবান্ধব করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে ইন্টারনেট সেবা, স্যাটেলাইট টেলিভিশন, অনলাইন ব্যাংকিং ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা হবে।
শহরের সঙ্গে যোগাযোগ হবে নিরবচ্ছিন্ন। যেখানে বিদ্যুৎ সুবিধা নেই, সেখানে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে। সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে পল্লী এলাকার উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হবে। একই সঙ্গে পল্লীর দারিদ্র্যবিমোচনেও বরাদ্দ বাড়ানো হবে।
এর মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়া হবে। আগামী বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হবে।
মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যেই রাখার লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়াও উৎপাদন খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে বহুমুখী উদ্যোগ থাকছে।
এর একটি অংশ যাবে গ্রামে। এর মধ্যে কৃষি ঋণের প্রবাহ, গ্রামীণ ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণের জোগান বাড়ানো হবে। আসন্ন বাজেটে চমক হিসেবে থাকবে বহুল আলোচিত তিন স্তরের ভ্যাট ঘোষণা, পহেলা জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইনের আংশিক কার্যকর, অটোমেশনের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র সেবা চালু, খেলাপি ঋণ আদায়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন, কর্পোরেট কর হার হ্রাসের ঘোষণাও। কৃষকদের আনা হবে বীমার আওতায়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে বের করে আনতে সংশ্লিষ্ট পরিবারে একটি করে চাকরি দেয়ার কর্মসূচিও ঘোষণাতে থাকবে। রাজস্ব আদায়ে জনগণের ওপর চাপ না দিয়ে নতুন ক্ষেত্র ও আওতায় সম্প্রসারণের নীতি নেয়া হবে নতুন বাজেটে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কোনো ধরনের চাপ দেয়া হবে না। প্রত্যেক বিভাগকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজ উদ্যোগে আয় করতে হবে। সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থানের দিকে।
এছাড়া গ্রামীণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে থাকবে বিশেষ পদক্ষেপ। আগামী জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর জুনের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু এ বছর রোজার ঈদের ছুটির কারণে জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণার দিনক্ষণ কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ১৩ শতাংশ বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মতে, নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে আমার গ্রাম আমার শহর ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মনোযোগ দেয়া হয়েছে।
সে ধারাবাহিকতায় দেশের প্রতিটা গ্রাম শহরে রূপান্তর করা হবে। যেখানে সেখানে হাটবাজার হবে না। জমি সাশ্রয় করে কৃষি কাজে ব্যবহার করা হবে। দেশের তরুণেরা ভবিষ্যৎ। তরুণ প্রজন্মের জন্য বেশি বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এমনসব উদ্যোগ থাকবে বাজেটে।
রাজস্ব : নতুন বাজেটে সম্ভাব্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হবে ৩ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। তবে বরাবরের মতো ৫ শতাংশ ঘাটতি ধরে এ বাজেট প্রণয়ন করা হবে। নতুন সরকারকে কর রাজস্ব আদায় করতে হবে ৩ লাখ ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
এরমধ্যে এনবিআর কর ৩ লাখ ৪১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, এনবিআর বহির্ভূত ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা এবং করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় করতে হবে ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এছাড়া আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন তিন স্তরে কার্যকর করা হবে- যা ৫ শতাংশ, ৭ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ হারে হবে। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশের ভ্যাট ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। আয়কর ও কর্পোরেট কর কমানোর ঘোষণা আসতে পারে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হার কমিয়ে আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হবে।
বিনিয়োগ :আসন্ন বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ থাকবে। কারণ পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আনার উদ্যোগ থাকছে। এছাড়া আগামী পহেলা জুলাই থেকে দেশব্যাপী অটোমেশন পদ্ধতিতে (অনলাইন) সঞ্চয়পত্র বিক্রির কার্যক্রম শুরু হবে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে সঞ্চয় স্কিমের সুদ ও আসল সরাসরি গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে চলে যাবে। এ উদ্যোগের ঘোষণা থাকছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি :আসন্ন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রাথমিকভাবে বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে এ খাতে বরাদ্দ চেয়ে প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছে। এডিবির লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত চাহিদা ৯৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ হিসাব মেলাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। চলতি সংশোধিত উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের তুলনায় আগামীতে প্রায় ২২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা বেশি খরচের সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।
নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী নতুন সরকারকে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি চলতি বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বাড়ানো হবে। ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি বাড়ানো হবে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। পরিবেশ ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ, আমদানি খাতের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ ও রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই হিসাব মাথায় রেখে নতুন সরকারের জন্য এসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে।