আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন ও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে বিশেষ নজরের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনের কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এ ধরনের কৌশল নিলে সমাজে অসমতা ও বঞ্চনা দূর করতে সহায়ক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে। অর্থনীতির চলমান কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটের কৌশল প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের জন্য তৈরি একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে সমাজে আয়ের বৈষম্য কমাতে পরিবেশবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে নজর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য উৎপাদন খাতের ওপর জোর দেয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।
অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে আছেন বাণিজ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আজ বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে এই কাউন্সিলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এটাই কাউন্সিলের প্রথম বৈঠক। এতে সরকারের আগামী অর্থবছরের আর্থিক ব্যবস্থাপনার কৌশল ঠিক করা হবে। একই সঙ্গে আগামী অর্থবছরের বাজেটের কৌশলগত কাঠামো কেমন হবে তা নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া আলোচনা হবে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর ধারণাপত্র নিয়েও।
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এটা সরকারের প্রথম বাজেট। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালও এবারই প্রথম বাজেট দেবেন। সরকার ক্ষমতায় এসেই আর্থিকসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কার কাজে হাত দিয়েছেন।
এমন এক সময় অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়নের কাজে হাতে দিয়েছেন যখন অর্থনীতিতে রয়েছে স্থিতিশীলতা। এছাড়া আছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। এর মধ্যেই আগামী বাজেটের মাধ্যমে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। নির্বাচনী উল্লেখযোগ্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে আছে গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য নিরসন। এসব প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকারকে অবকাঠামো নির্মাণেই বেশি জোর দিতে হবে। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটে রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক বিষয় গুরুত্ব দেয়া উচিত। অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণ সহজ হবে। আর অর্থনীতিকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজনীতিকে গুরুত্ব দিলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেকসই হবে না। তিনি আরও বলেন, সমাজে আয় বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে সমতা ফিরিয়ে আনায় গুরুত্ব দিতে হবে। এবারের বাজেটে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান বাড়ানোর পাশাপাশি এ বিষয়েও বিশেষ নজর রাখা জরুরি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজস্ব কৌশল ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আয় বণ্টনে সমতা আনার চলমান উদ্যোগকে আরও জোরদার করতে হবে। এর মাধ্যমে সমাজের উঁচু স্তর থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে নিচু স্তরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এতে একদিকে প্রবৃদ্ধির ধারা টেকসই হবে, অন্যদিকে সমাজে আয় বৈষম্য কমে আসবে।
এ লক্ষ্যে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে দক্ষ শ্রমশক্তি। পুঁজি ও ঋণের জোগান বাড়াতে বিকল্প মূলধন বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোতে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উৎপাদন খাতের অবদান জিডিপিতে বেশি হতে হবে। দেশের অর্থনীতি এখন সেদিকেই যাচ্ছে। কৃষির চেয়ে শিল্প খাতের অবদান বাড়ছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত বাজেটে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী বাজেটে শিল্প খাতের অবদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। গত বাজেটে ছিল শিল্প খাতে ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে সেবা খাতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বাজেটে ছিল ছিল ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আগামী বাজেটে দারিদ্র্য বিমোচন ও অসমতা কমানোর লক্ষ্যে মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর ওপর জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।
ফলে মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান বাড়বে। ফলে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ ধীরে ধীরে উচ্চ বেতনের চাকরিতে প্রবেশ করতে পারবে। এতে আয় বাড়বে দরিদ্র মানুষের। এভাবে সমাজে অসমতা ও দারিদ্র্য কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী বাজেটে এ ধরনেরই কৌশল রাখা হবে।
এছাড়া আগামী বাজেটে উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ নজর দেয়া হবে। শিক্ষিত যুবক এবং বর্তমানে ছোটখাটো ব্যবসায় আছেন এমন উদ্যোগীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এর ভিত্তিতে ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তা তৈরি করা হবে। যাতে তারা নিজেরা উচ্চ আয়ের পথ সুগম করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ঋণের জোগান বাড়াতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোতে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে হবে। তবেই ঋণের জোগান বাড়ানো সম্ভব হবে। ঋণের জোগান না বাড়লে উদ্যোক্তারা কেবল নিজেদের পুঁজিতে বড় বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে না।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ৭ দশমকি ৮ শতাংশ। এ হার ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ অর্জিত হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হবে বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে কাউন্সিলের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৩ থেকে ৪ শতাংশ ধরা যেতে পারে।
এদিকে প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৩ থেকে ৪ শতাংশ ধরে আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা, মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার প্রস্তাব করা হয়েছে।
একই সঙ্গে রাজস্ব আয় জিডিপির ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ, রাজস্ববহির্ভূত আয় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ ১৭ শতাংশ, টাকার প্রবাহ ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে অবকাঠামোর উন্নতি হয়। অবকাঠামো বাড়লে তখন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়। এতে কর্মসংস্থান বাড়ে।
এ কারণে এবারের বাজেটে সরকারি বড় প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়া এবং ছোট-বড় আরও অবকাঠামো নির্মাণে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে মোট সরকারি ব্যয় জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ হার আগামী বাজেটে আরও বাড়াতে চায় সরকার।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ। এটা আগামী বছরে ২ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজে বৈষম্য কমাতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে সরকার জিটু পারসন একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় সরকারি সুবিধা সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এর আওতা আগামী বাজেটে আরও বাড়ানো হবে।