চলতি অর্থবছর বা কর বছর থেকে কোম্পানি করদাতাদের আয়কর রিটার্নে আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য দিতে হবে। গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। এনবিআরের কর আইন-২ শাখার দ্বিতীয় সচিব মো. মাজহারুল হক ভূঁঞা স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, কোম্পানি করদাতাদের জন্য নতুন আয়কর রিটার্ন ফরম প্রবর্তন করা হয়েছে। রিটার্ন ফরমে কোম্পানিগুলোকে আন্তর্জাতিক লেনদেনসংক্রান্ত ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চলতি কর বছর থেকে কোম্পানিগুলোকে নতুন ফরমে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। আর কোম্পানি করদাতাদের জন্য প্রচলিত অন্যান্য ফরমের কার্যকারিতা থাকবে না।
আন্তর্জাতিক লেনদেন প্রসঙ্গে এনবিআরের কর আইন-১ শাখার দ্বিতীয় সচিব সুমন দাস বলেন, আন্তর্জাতিক লেনদেনের সংজ্ঞা আমাদের আয়কর আইনে দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি অন্য দেশের কোনো কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন করলে সেটা আন্তর্জাতিক লেনদেন হবে। এখানে অন্য দেশের কোম্পানির যদি বাংলাদেশে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান থাকে আর সে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশীয় কোম্পানি লেনদেন করলেও তা আন্তর্জাতিক লেনদেন হবে। অর্থাৎ বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে নিবাসী হোক আর অনিবাসী হোক, তাদের সঙ্গে দেশীয় কোম্পানি লেনদেন করলেও আন্তর্জাতিক লেনদেন হিসেবে সেটা বিবেচনা করা হবে। আবার দেশীয় কোম্পানি বিদেশে অফিস করে সেখানে অন্য কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন করলে সেটা আন্তর্জাতিক লেনদেন হিসেবে আয়কর রিটার্নে ঘোষণা করতে হবে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে জানা যায়, কর ফাঁকি ও দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এনবিআর। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত এমন প্রায় হাজারটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে সংস্থাটি।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বোর্ডসভায় ৯২১টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এনবিআর। এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুসারে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরুও করেছেন কর কর্মকর্তারা।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের অডিট করবে এনবিআর। এছাড়া অডিটের পর প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্যই আলাদা ট্যাক্স প্রোফাইল পরিচালনা করবে সংস্থাটি।
প্রাথমিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নিরীক্ষার আওতায় আনা হবে। প্রথমে ব্যবসার ধরন ও লেনদেনের উপাত্ত পরিপূর্ণভাবে জানা হবে। এরপর পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুসারে প্রশ্নপত্র তৈরি করে তাদের কাছ থেকে উত্তর আদায় করা হবে।
বিদেশী কোম্পানিগুলোর শাখা কোম্পানি সুদ, মুনাফা, কোনো সম্পদ কিংবা কোনো পণ্যের মূল্য মূল কোম্পানিতে পাঠায়। এছাড়া পণ্য বা সেবা আমদানির মূল্যও মূল কোম্পানি বা অন্য কোনো কোম্পানিকে পাঠায়। এটি ট্রান্সফার প্রাইসিং হিসেবে পরিচিত। তবে পণ্যের দর কম বা বেশি দেখিয়ে কিংবা মুনাফার অর্থ পাঠানোর মিথ্যা তথ্য দেয়ার মাধ্যমে কর ফাঁকির পাশাপাশি অর্থ পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
এছাড়া অভিযোগ আছে, দেশে অনেক বিদেশী আছেন, যারা উচ্চ বেতনে চাকরি করলেও রিটার্ন জমা দেন না বা কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রকৃত বেতন-ভাতা রিটার্নে গোপন করে থাকেন। চলতি অর্থবছরে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ করতে বিদেশীদের এ ধরনের কর অনিয়ম প্রতিরোধে বিশেষ সতর্ক এনবিআর।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর সূত্র জানায়, ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে বহুজাতিক ও দেশীয় কোম্পানির রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ পাচার ঠেকাতে কোম্পানির আয়কর রিটার্নে আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য আলাদাভাবে উপস্থাপনের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ বহুজাতিক কোম্পানি এবং দেশীয় কোম্পানিগুলো যারা বিদেশে ব্যবসা করছে, তারা কর ফাঁকি দিয়ে নিজেদের এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য দেশে অবস্থিত সহযোগী প্রতিষ্ঠানে অর্থ নিয়ে যায়। সাধারণত করহার বেশি, এমন দেশ থেকে করহার কম এমন দেশের সহযোগী প্রতিষ্ঠানে এ অর্থ পাঠানো হয়। এটা এক ধরনের অর্থ পাচার। এটি প্রতিরোধে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল গঠনও করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের কর আইনের প্রথম সচিব মো. আমিনুর রহমান বলেন, মূলত ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলের হিসাব সহজ করার জন্য আমরা সব ধরনের কোম্পানি, যারা বিদেশে এবং বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করছে এরূপ আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্য আয়কর রিটার্নে দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। এতে কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি কিংবা টাকা পাচার করছে কিনা, এ হিসাব করা সহজ হবে।