নোভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখার নিমিত্তে ভ্যাট আইন ২০১২ ও আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এ সংযোজনকৃত নতুন ধারা বাতিল চায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), দ্য ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ও বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিইউআইএলডি)। গতকাল এক যৌথ সংবাদ বিবৃতির মাধ্যমে এ দাবি জানানো হয়। বৈশ্বিক অর্থনীতি তথা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বাজেট আমাদের কাছে ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজেট হিসেবে বিবেচিত হবে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, এ বছরের অর্থ বিল পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পেয়েছি যে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ও ভ্যাট আইন ২০১২-তে কিছু নতুন ধারা সংযোজন করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা শুধু এই কভিড-১৯ মহামারীপ্রসূত দুঃসহ সময়েই নয়, সাধারণভাবেই ব্যবসায় পরিচালনায় জটিলতা বাড়াবে এবং ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হবে। একই সঙ্গে রাজস্ব বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে না; বরং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায়ও জটিলতার সৃষ্টি করবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ও ভ্যাট আইন ২০১২-এর এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো ব্যবসাবান্ধব বা রাজস্ববান্ধব কোনোটাই নয়। বরং অর্থনীতিতে গতিসঞ্চালন বাধাগ্রস্ত করবে। সরকারের প্রতি আমাদের বিনীত নিবেদন, উল্লিখিত প্রতিটি ধারা সম্পর্কে আমাদের যুক্তিগুলো অনুধাবন করে দেশের এবং অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে ওই পরিবর্তনগুলো যেন আইনে অন্তর্ভুক্ত না করা হয়। আমাদের নিবেদন সরকারের ইতিবাচক ভূমিকা ও সিদ্ধান্ত আমাদের বাধিত করবে এবং দেশের অর্থনীতির উত্তরণের গতি ত্বরান্বিত করবে।
মূল্য সংযোজন কর আইন ২০১২-এ সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো সম্পর্কে বিবৃতিতে বলা হয়, ব্যবহারের ভিত্তিতে ইনপুট রেয়াতের অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের শতাধিক কাঁচামাল ব্যবহারের পূর্বাপর বিবরণ বা ট্র্যাক রেকর্ড সংরক্ষণ করা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল জটিলতা সৃষ্টি করবে। এছাড়া ইনপুট রেয়াত গ্রহণ বিলম্বিত যেমন হবে, তেমনি চার মাসের মধ্যে গ্রহণ করা সম্ভব না হলে একেবারেই পাওয়া যাবে না। যদিও ব্যবসায়ী তার সরবরাহকারীকে অর্থ প্রদান করে ফেলেছেন। অর্থাৎ সেই অর্থ ব্যবসায়ীর পকেট থেকে যাবে, যা ন্যয়সংগত নয় এবং মূল্য সংযোজন করের ধারণার পরিপন্থী।
ব্যবসায়ীরা একই পরিমাণ রেয়াত দাবি করায় এনবিআরের রাজস্ব আহরণে কোনো সুবিধা নেই। কেবল এক মাসের পরিবর্তে এনবিআর চার মাস সময় পাবে এই অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য এবং অধিকতর তিন মাস সময় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ অর্থ ব্যবহার করার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, যাতে তার উৎপাদন ব্যয় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। আর যদি কোনো অসাধু ব্যবসায়ী একই রেয়াত সেই চার মাসে একাধিকবার দাবি করেন তাহলে প্রতারণা-রাজস্ব ফাঁকি খুঁজে বের করা আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হবে বলে মনে করে সংগঠনগুলো।
আপিলের জন্য পরিশোধযোগ্য বিতর্কিত ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়, এ ধারার প্রভাবে করদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর আপিলের পূর্বশর্ত পালন করার বোঝা অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পাবে। যখন ভ্যাট আরোপ অযৌক্তিক ও মাত্রাতিরিক্ত হবে, তখন তা বহন করে যৌক্তিক ক্ষেত্রেও আপিল করা দুঃসাধ্য হবে; যা ন্যায়সংগত নয়। অনেক ক্ষেত্রে আইনানুগ যুক্তিসংগত ভ্যাট আরোপ না করে মাত্রাতিরিক্ত আরোপের পর এই ১০ শতাংশ বা ২০ শতাংশ জমার মাধ্যমে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রবণতা দেখা যায়।
ইনপুট ভ্যাট রেয়াতে বৈধ ব্যবসার খরচের ওপর বাধা-নিষেধ ভ্যাটের মূলনীতির বিপরীত এমন তথ্য উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এটি বৈধ ব্যবসায়ের ব্যয়, ততক্ষণ রাজস্ব হোক বা মূলধন প্রকৃতির হোক না কেন ইনপুট ভ্যাট রেয়াত পাওয়া উচিত। তা না হলে এটি আর মূল্য সংযোজন কর থাকে না। বিক্রয় কর (সেলস ট্যাক্স) জাতীয় করে পরিণত হয়। এতে ভ্যাট আইন ২০১২ দ্বারা কৃত সংস্কার থেকে পুনরায় পুরনো পদ্ধতির দিকে ফিরে যাওয়া হচ্ছে, যা অবাঞ্ছনীয়।
বিস্তৃতভাবে উইথহোল্ডিং ভ্যাট পুনরায় চালু করা সম্পূর্ণরূপে ভ্যাট প্রক্রিয়াকে বিকৃত ও জটিল করে তোলে। যুক্তিসংগতভাবে ভ্যাট আইন ২০১২-তে বিশেষভাবে উইথহোল্ডিং ভ্যাটের পরিধি কমিয়ে আনা হয়েছিল। অর্থ বিল ২০২০ উইথহোল্ডিং ভ্যাট বিষয়ে ভ্যাট আইন ১৯৯১-এর মডেল পুনরায় চালু করার প্রস্তাব করছে। পশ্চাত্মুখী এ পরিবর্তন বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-তে সংযোজিত টার্নওভারের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদনযোগ্য বিজ্ঞাপন ব্যয়ের ওপর বাধা-নিষেধের বিষয়ে বলা হয়েছে, এটি ব্যবসার একটি যৌক্তিক ও আইনসংগত ব্যয়। এটার ওপর বাধা-নিষেধ বা সীমা আরোপ কেন করা হবে? অনেক খাত যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য (এফএমসিজি), টেলিকম, ওষুধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এটি ব্যবসার অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রস্তাবিত পরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়িক খরচের বড় একটি অংশ অযৌক্তিকভাবে অননুমোদিত ব্যয় হিসেবে গণ্য হবে এবং করের বোঝা বাড়াবে। এতে করের চাপ বৃদ্ধির কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরও আশঙ্কা রয়েছে।
করপোরেট করহার প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা সাধারণ ক্যাটাগরির অতালিকাভুক্ত কোম্পানির (এটি ব্যাংক বা টেলিকম খাত নয়) করপোরেট করহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ করাকে স্বাগত জানাই। দুর্ভাগ্যক্রমে, উচ্চ এআইটি/টিডিএস হারের কারণে করহার কমানোর খুব কম উপকার পাওয়া যাবে বা ক্ষেত্রবিশেষে কোনো উপকারই হবে না।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, আমদানি পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা ৫ শতাংশ অর্থ প্রদান করে (শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য এআইটি হিসেবে) এবং তার পরে গ্রাহকদের যখন এ পণ্যগুলো সরবরাহ করে তখন আবার ৫ শতাংশ পর্যন্ত টিডিএস প্রদান করতে হয়। কিছু পরিষেবা সরবরাহকারীদের জন্য এটি ১০ শতাংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুনাফার ওপর ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ করপোরেট কর এই উৎস করের তুলনায় অনেক কম হবে। তখন উেস করটিকেই ন্যূনতম কর হিসেবে গণ্য করা হবে, অর্থাৎ আয়কর আসলে যা হওয়া উচিত, তার চেয়ে বেশি হবে।
উেস কর নিট মুনাফার ওপর ৩২ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে থাকতে হলে নিট মুনাফার মার্জিন ২৫ শতাংশের বেশি হতে হবে বলে মনে করে সংগঠনগুলো। তারা বলছে, খুব কম ব্যবসায়েই এমনকি গ্রস প্রফিটের জন্য এত উচ্চ মার্জিন রয়েছে। আমরা টিডিএস/এআইটির এই হার যৌক্তিক করার দাবি জানাচ্ছি।
গ্র্যাচুইটির ওপর কর প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়, অননুমোদিত বা আনফান্ডেড গ্র্যাচুইটির জন্য কর্মীদের প্রদেয় গ্র্যাচুইটি আয়করযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। অধিকাংশ কর্মীর ক্ষেত্রে এটি তাদের জীবনের সঞ্চয়। কর্মীদের ওপর কর আরোপ করা অন্যায়। ব্যবসায়ীদের গ্র্যাচুইটি স্কিম ফান্ড করতে বাধ্য করা সীমিত সম্পদের কার্যকর ব্যবহার না-ও হতে পারে। কেননা এতে বিশাল পরিমাণ অর্থ দীর্ঘ সময়ের জন্য অলস/অব্যবহূত থাকবে। আমরা এই বিধান বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।