নতুন অর্থবছরের বাজেটে বড় ধরনের ভ্যাট ছাড় সুবিধার আওতায় আসছে আমদানিনির্ভর দেশি ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স শিল্পের বেশ কয়েকটি পণ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কর্মকর্তারা এমন তথ্য জানিয়েছেন।এনবিআরের তথ্যমতে, ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স শিল্পের পণ্যের চলমান শুল্ক-কর সুবিধাও আগামী বাজেটে অব্যাহত রাখা হবে। সেক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট ছাড় পেতে যাচ্ছে এই খাতের সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু পণ্য। এছাড়া এই খাতে নতুন কারখানা স্থাপনে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হবে ১০ বছর পর্যন্ত। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, স্থানীয় বিনিয়োগ প্রবাহ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এবং দেশীয় পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বিদেশ নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এ জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে আমদানিনির্ভর বেশ কিছু পণ্যে আয়কর ও ভ্যাটে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করবে এনবিআর। আগামী ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে যে বাজেট বক্তৃতা দেবেন, সেখানে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের জন্য এসব সুবিধা ঘোষণা করতে পারেন অর্থমন্ত্রী।
জানা গেছে, আগামী বাজেটে দেশি কোম্পানির উৎপাদিত সেলফোন হ্যান্ডসেট, লিফট, রেফ্রিজারেটর, এসি, ফ্রিজ, অটোমোবাইল, টিভিসহ ইলেকট্রনিকস ও অটোমোবাইল শিল্পের জন্য ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে। তিন বছরের জন্য এ সুবিধা বহাল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড় সুবিধা চলমান রয়েছে। এছাড়া ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক সুইং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডারসহ হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদনে নতুন করে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা আসতে পারে আগামী বাজেটে। হোম অ্যাপ্লায়েন্স সামগ্রীর জন্য নতুন করে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হবে। এ সুবিধা শুধু উৎপাদন পর্যায়ে দেওয়া হবে। বিক্রিতে ভ্যাট থাকবে না। অপরদিকে ইলেকট্রনিকস ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের পণ্য উৎপাদনের জন্য নতুন কারখানা স্থাপন করলে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধার ঘোষণাও আসতে পারে আগামী বাজেটে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা সংকট কাটিয়ে অর্থনীতি গতিশীল করতে দেশি শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশীয় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে দেশের কর্মসংস্থানে বড় অবদান রাখা সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, করোনায় দেশি শিল্প সচল রাখার মাধ্যমে আমদানির বিকল্প শিল্পোৎপাদনে জোর দেওয়া জরুরি।
জানা গেছে, দেশে হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজার ছাড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এরইমধ্যে দেশে ১৫টি ব্র্যান্ড নিয়ে এসব খাতে বিনিয়োগ করেছে একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান। বাজারের বেশিরভাগই দেশে তৈরি ফ্রিজ ও টেলিভিশনের দখলে রয়েছে। সার্বিকভাবে হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের হার ১৫-২০ শতাংশের কম নয়। তবে সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ হয়েছে ফ্রিজের বাজার। প্রসঙ্গত, প্রতি বছর দেশে গড়ে সাত লাখ পিসের বেশি রেফ্রিজারেটর কিংবা ফ্রিজের চাহিদা রয়েছে। পণ্যটির উৎপাদন ক্ষমতা ছাড়িয়েছে প্রায় ১৫ লাখ পিস। এছাড়া দেশের কয়েকটি কোম্পানি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের পণ্য রফতানি শুরু করেছে। এদিকে শিল্পায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আসন্ন বাজেটে আইটি খাত ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে কর অব্যাহতির সুবিধা আরও সম্প্রসারিত হতে যাচ্ছে। এনবিআর সূত্র বলছে, বিদ্যমান ২২টির পাশাপাশি আইটি খাতের আরও নতুন পাঁচটি সেবাকে কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সেবাগুলো হচ্ছে ক্লাডউ সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস এবং ফ্রিল্যান্সিং।
বর্তমানে যেসব খাত কর অব্যাহতির সুবিধা ভোগ করছে সেগুলো হচ্ছে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, এনটিটিএন, ডিজিটাল কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট সার্ভিস, ওয়েব লিস্টিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, ডিজিটাল গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রি অ্যান্ড প্রসেসিং, ডিজিটাল ডাটা অ্যানালেটিক্স, জিওগ্রাফিক্স ইনফরমেশন সার্ভিসেস, আইটি সাপোর্ট অ্যান্ড সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, সফটওয়্যার ল্যাব টেস্ট সার্ভিস, কল সেন্টার সার্ভিস, ওভারসিজ মেডিক্যাল ট্রান্সক্রিপশনস সার্ভিস, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন, রোবোটিক্স প্রসেস আউটসোর্সিং এবং সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস। এনবিআর মনে করে, এসব খাতে কর অব্যাহতি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে এবং অর্থনীতির ডিজিটাল ট্রান্সমিশনকে ত্বরান্বিত করবে। পাশাপাশি এসব খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে। সহজে ও কম খরচে মানুষ উন্নত ডিজিটাল সেবা পাবে।
প্রসঙ্গত, অনেক সফটওয়্যার আছে যেগুলো দেশে তৈরি হয় না, কাজের প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আনতে হয়। এ ধরনের সফটওয়্যার আনতে ২৫ থেকে ৫৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অপরদিকে বাজেটে দক্ষতা উন্নয়ন ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে কর অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে। এনবিআর মনে করে, বাংলাদেশে শিল্পায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা। তাছাড়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার জন্য শিল্প উদ্যোক্তা তৈরি সময়ের দাবি। তাই জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে কর অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক লেনদেনে কর ছাড় দেওয়া হবে। একইসঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় আনতে বাজেটে নতুন পদক্ষেপ থাকবে। শিল্প বা কারখানায় তাদের চাকরি দিলে উদ্যোক্তাদের নির্দিষ্ট অঙ্কের কর ছাড় দেওয়া হবে।
আগামী অর্থবছরে কোনও প্রতিষ্ঠান তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের বছরের পুরো সময় মোট জনবলের ১০ শতাংশ বা ১০০ জনের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে চাকরি দিলে প্রদেয় করের ৫ শতাংশ রেয়াত পাবে। এদিকে বর্তমানে বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারধারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান কর অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। আগামী বাজেটে নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এই সীমা এক কোটি করা হচ্ছে। অর্থাৎ বছরে এক কোটি টাকা বিক্রিতে নারীদের কর দিতে হবে না।