মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে গতকাল রোববার ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে। এতে কারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তা এখন সবারই জানা। গত ২০ নভেম্বর শুরু হয়েছিল বৈশ্বিক এ আয়োজন। এবারের ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে সারা দুনিয়ায় এক মাস ধরে যেসব আলোচনা-আগ্রহ, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আবেগ-উত্তেজনা দেখা গিয়েছিল, সেগুলো এরই মধ্যে স্তিমিত হতে শুরু করেছে। তবে এখন আলোচনায় উঠে আসছে বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা ও এ খাতের আয়ের বিষয়টি। কারণ, এ আয়োজন কাতার সরকার ও জনগণের সামনে দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও বিপণনের এক অবারিত সুযোগ এনে দিয়েছে। ফলে ছোট্ট উপসাগরীয় দেশ কাতার এখন পর্যটন ব্র্যান্ড হিসেবে অর্থ উপার্জনের নতুন সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে।
ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রান্ত থেকে কাতারে সব মিলিয়ে ১ কোটি ২০ লাখ থেকে দেড় কোটি মানুষের সমাগম ঘটবে, আর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ বিশ্বকাপের খেলা দেখবেন বলে আশা করা হয়েছিল।
ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতারকে এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। এ জন্য দেশটিকে সার্বিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে প্রায় ২২ হাজার কোটি থেকে ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। অবশ্য কাতারের আর্থিক সক্ষমতা বেশ ভালো। কাতার সরকার চলতি ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১ হাজার ৭৮৫ কোটি ডলার ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ২ হাজার ৩৫৪ কোটি ডলার আয় করেছে।
বিশ্বকাপ আয়োজনকে কেন্দ্র করে কাতার সরকার শুরু থেকেই পর্যটনশিল্পের বিকাশে জোর দিয়েছে। যেমন ২০১৪ সালে তারা জাতীয় পর্যটনশিল্প কৌশল ২০৩০ গঠন করে। কৌশলটির লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিবছর সব মিলিয়ে ৭০ লাখের বেশি পর্যটক আকর্ষণ করা। অভ্যন্তরীণ পর্যটনের সংখ্যা প্রাক্কলন করা হয় ২৫ লাখ। অথচ ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ লাখ। কাতারি কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যা বাড়াতে, উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে এবং বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করতে উন্নয়নের প্রধান ইঞ্জিন হয়ে উঠবে পর্যটনশিল্প। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১২ শতাংশে উন্নীত করা।
কাতারের পর্যটন খাতে চলতি বছরের প্রথম দিক থেকেই সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। এ বছরের প্রথমার্ধেই দেশটিতে ৭ লাখ ২৯ হাজার আন্তর্জাতিক পর্যটক এসেছেন, যেটাকে পর্যটনশিল্পের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পূর্বলক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, ওই সংখ্যা আগের বছরের, অর্থাৎ গোটা ২০২১ সালের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেশি। এখন কাতারের অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ১২ শতাংশে উন্নীত করা।
বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে কাতারের ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে এটিই বিশ্বকাপ আয়োজনে স্বাগতিক দেশের সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড। ২০১৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনে রাশিয়ার আয় হয়েছিল ৫৪০ কোটি ডলার। সেটিও ছিল সর্বোচ্চ আয়ের রেকর্ড। এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু বিশ্বকাপ আয়োজন থেকেই কাতারের অর্থনীতিতে দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলার যোগ হতে পারে। আর কাতারের জিডিপিতে ২০২২ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক ৩ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে।
ভৌগোলিকভাবেও অবশ্য কাতারের পর্যটনশিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই মাত্র ছয় ঘণ্টার ফ্লাইটে বা উড়ানে কাতারে আসা-যাওয়া করতে পারেন। বিষয়টি মাথায় রেখেই কাতার সরকার ফিফা বিশ্বকাপের জন্য ১৫০টির বেশি অত্যাধুনিক হোটেল তৈরি করেছে। এসব হোটেল ভবিষ্যতে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
বিশ্বকাপ আয়োজনকে কাতার পর্যটনশিল্পের বিকাশসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচনায় নিয়েছে। সে লক্ষ্যে তারা রাজধানী ও প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র দোহাকে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলার কৌশল গ্রহণ করে। ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) মতে, বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমছে, সেখানে কাতারের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) চলতি ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। জার্মানির একটি সংবাদপত্রে ড. কেটনার নামের একজন বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি দেশটির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ দোহা সফর উপলক্ষে লিখেছেন, যে কাতারকে উপেক্ষা করবে, সে হেরে যাবে। সূত্র: ইউরোনিউজ, জাম্পস্টার্টম্যাগ ডটকম