করছাড়ের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরবর্তী কিস্তির অর্থ পাওয়া এবং কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বড় ধরনের সংস্কারে হাত দিয়েছে সংস্থাটি।আইএমএফ ইতোমধ্যে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে করছাড় কমানোর ব্যাপারে এনবিআরকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাটি রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় ও বিভিন্ন ধরনের বন্ডে সরকারের দেওয়া কর-সুবিধা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া শেয়ারবাজার থেকে অর্জিত আয়ের ওপর দেওয়া করছাড়ও বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছে তারা। শুধু তা-ই নয়, এনবিআরের মাধ্যমে করছাড় দেওয়ার যেসব বিধান রয়েছে, সেগুলো বাতিলের পাশাপাশি বিদ্যমান করছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা আর না বাড়ানোর সুপারিশ করেছে আইএমএফ। এ ছাড়া ব্যক্তি খাতে বিদ্যমান করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি ন্যূনতম করহার ৫ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর নানামুখী সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে মেট্রোরেলের টিকিটের ওপর বর্তমানে ভ্যাট মওকুফ রয়েছে, যার সময়সীমা আগামী ৩০ জুন শেষ হবে। যদিও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য এনবিআরকে অনুরোধ করে ডিএমটিসিএল। তবে এনবিআর এ খাতের ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ আর বাড়াবে না। ফলে আগামীতে মেট্রোরেলের ভাড়া বাড়বে। এতে বাড়তি চাপ পড়বে সাধারণ যাত্রীর ওপর।
অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ২৭ ধরনের সেবার ওপর দীর্ঘদিন ধরে দিয়ে আসা কর অব্যাহতি আগামী বাজেট থেকে প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা করছে এনবিআর। এর ফলে আগামী অর্থবছর থেকে আইটি খাতের ওই সব সেবার আয়ের ওপর কর আরোপ হতে পারে।এদিকে আয়কর খাতের করছাড় নিয়ে এক প্রতিবেদন তৈরি করছে এনবিআর। আয়কর বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকার আয়কর ছাড় দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৬৮ শতাংশ বা ৮৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকার করপোরেট করছাড় দেওয়া হয়। বাকি প্রায় সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকার ছাড় দেওয়া হয় ব্যক্তিপর্যায়ের করদাতাদের। হিসাবটি করা হয়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরের আয়কর ধরে। এনবিআর বলছে, ছাড় দেওয়া আয়করের পরিমাণ ওই বছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশের সমান।অন্যদিকে মূল্য সংযোজন করের ছাড় নিয়ে বিশ^ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে- ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট আদায় করা সম্ভব ছিল। তবে ওই বছর সরকার মাত্র ৮৫ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট সংগ্রহ করতে পেরেছিল। সংস্থাটির মতে, ভ্যাট অবকাশ বন্ধ করা, সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করাসহ নিয়মনীতি পরিপালন করা গেলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করা যেত। অর্থাৎ আদায়যোগ্য ভ্যাটের চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ কম ভ্যাট আদায় হয়েছে।
নীতিগত অবস্থানের কারণে ভ্যাট আদায়ে এমন ব্যবধান থাকছে। নীতি ও বিধিবিধান পরিপালনের ব্যবধান কমাতে পারলে অতিরিক্ত মূল্য সংযোজন কর আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব নীতি ও দুর্বলতার কারণে ভ্যাট আদায় হয়নি, তার মধ্যে রয়েছে বড় অঙ্কের ভ্যাট-ছাড়, ভ্যাট আদায় পদ্ধতিতে ফাঁকফোকর থাকা, নিয়মের অপর্যাপ্ত প্রয়োগ প্রভৃতি।অন্যদিকে সরকার বিভিন্ন বিবেচনায় ভ্যাট আদায়ে ছাড় ও প্রণোদনা দেয়। এগুলো বিবেচনায় নিলে সম্ভাব্য ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় দেড় লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই বিবেচনায়ও ভ্যাট আদায়ে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকে।বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, শুধু আইএমএফের শর্ত পালন নয়, দেশের রাজস্ব বাড়ানোর প্রয়োজনেই করছাড় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। কয়েকটি খাতে কর মওকুফের পরিমাণ কমানো হলে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের আয় ৩০ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। কর মওকুফের পরিমাণ কমিয়ে না দিলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে না। তিনি বলেন, কর খাতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। ব্রিটিশ আমলের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দিয়ে রাজস্ব আহরণ সম্ভব নয়। এ জন্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। এখন রাজস্ব সংস্কারের উপযুক্ত সময়। শিগগিরই আসন্ন অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হবে এবং তাতে সংস্কারের প্রতিফলন থাকতে হবে।