জন্মের পর থেকে ২৩ বার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইমএফ) আর্থিক সহায়তা নিয়েছে পাকিস্তান। এবার ২৪তম ঋণ কর্মসূচির বিষয়ে শিগগিরই ঐকমত্য হওয়ার কথা। দেশটির অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বলেছেন, পাকিস্তানের যে পরিস্থিতি তাতে কর আদায় বাড়ানো না গেলে এটাই শেষ নয়, ভবিষ্যতে আরও ঋণ নিতে হবে। নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর এই সতর্কবাণী দেন তিনি।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী বলেন, শিগগিরই আইএমএফের সঙ্গে কর্মকর্তা পর্যায়ে ঐকমত্য হওয়ার বিষয়ে তাঁর মধ্যে ‘যৌক্তিক আত্মবিশ্বাস’ আছে। ঋণের অঙ্ক কত, তা এখনো চূড়ান্ত না হলেও পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয় ৬০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে। কিন্তু এটাই শেষ নয়, কর আদায় না বাড়লে পাকিস্তানকে ভবিষ্যতে আবারও বেইলআউট নিতে হবে।
পাকিস্তানের অবস্থা অনেক দিন ধরেই ভালো না। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘরে, সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির গতি খুব কম আর বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও কমতির দিকে। এ পরিস্থিতিতে গত মার্চে মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। গত বছরও পাকিস্তান আইএমএফের ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া থেকে বেঁচেছে; সেবার ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ পেয়েছিল দেশটি। সেই ঋণ কর্মসূচি এপ্রিলে শেষ হয়েছে।
আইমএফের চাওয়া মেনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন খাতে করহার বাড়িয়েছেন পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী। কর বৃদ্ধির সঙ্গে জ্বালানি ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে তাঁকে।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধির পরিকল্পনা করেছে পাকিস্তানের অর্থ মন্ত্রণালয়। তাদের লক্ষ্য, আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে ৪ হাজার ৬৬০ কোটি ডলার রাজস্ব সংগ্রহ করা। রাজস্ব আদায় আরও বাড়ানো ছাড়া দেশটির বিশেষ কোনো উপায়ও নেই। বর্তমানে দেশটির রাজস্ব আয়ের ৫৭ শতাংশ সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়। ২০১৭-২১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের গড় সুদ ব্যয় ছিল রাজস্বের ৩৬ শতাংশ।
সমস্যা হচ্ছে, কর বৃদ্ধির কোপটা পড়বে বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ওপর। কিন্তু পাকিস্তানের অর্থনীতি এখনো মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক, তার সঙ্গে আছে কিছু খুচরা ও রপ্তানি ব্যবসা। এ পদ্ধতিতে কর আদায় খুব বেশি বাড়ানোর বাস্তবতা নেই। যাঁরা আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বাজেটে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আরোপের কথা বলা হয়েছে বাজেটে।
তবে পাকিস্তানিদের জন্য সুখবর হলো, সম্প্রতি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে কিছুটা উন্নতি দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের মার্চে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৩৮ শতাংশে উঠলেও গত জুনে তা ১২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩ বিলিয়নের নিচে নেমে এসেছিল, এখন তা ৯ বিলিয়নে উঠেছে। গত অর্থবছরে দেশটির অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল, এখন প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে।
মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, পাকিস্তানের অর্থনীতি ইতিবাচক পথে এগোচ্ছে, বিনিয়োগকারীরাও শেয়ারবাজারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। পাকিস্তানের শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক কেএসই ১০০ সূচক এশিয়ার শেয়ারসূচকগুলোর মধ্যে চলতি বছর সবচেয়ে ভালো করেছে। তারপরও তিনি মনে করেন, পাকিস্তান সরকারের সামনে কঠিন পথ। দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা ও ঋণ পরিস্থিতি টেকসই অবস্থায় নিতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
এদিকে শুধু আইএমএফের ওপর নির্ভর করছে না পাকিস্তান, দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সম্প্রতি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীন সফর করেছেন। তিনি এসব দেশের বিনিয়োগ চেয়েছেন।
সম্প্রতি কয়েক বছরে পাকিস্তানের ঋণ অনেকটা বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বন্ডহোল্ডারদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ উৎপাদনশীল ও রপ্তানিমুখী খাতে বিনিয়োগ করতে না পারায় তাদের এ পরিস্থিতি হয়েছে। ফলে ঋণ করে ঋণ শোধ করতে হয়েছে তাদের। মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব মনে করেন, পাকিস্তানের এখন ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া উচিত।
অর্থমন্ত্রী মনে করেন, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে। উপসাগরীয় অঞ্চলের বিনিয়োগকারীরা ইকুইটি বিনিয়োগ করে কোম্পানি পরিচালনা পর্ষদে আসন চান—মূলত তাঁদের এই দাবির বিষয়টি মাথায় রেখে বাস্তবসম্মত হওয়ার কথা বলেন তিনি। তাঁর মতে, উপসাগরীয় বিনিয়োগকারীদের দেশে আনতে পাকিস্তানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বল এখন পাকিস্তানের কোর্টে।
কর আদায় বৃদ্ধির পথে পাকিস্তানের রাজস্ব বোর্ডের দুর্নীতি বড় বাধা। সংস্থাটির সমালোচনা করে মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বলেন, রাজস্ব বোর্ডের দুর্নীতি ও হয়রানির কারণে মানুষ তাদের কাছে যেতে পারেন না, তারা স্পিড মানি দাবি করে। তিনি মনে করেন, এটা হতে পারে না।
পাকিস্তানের বাজেট রাজনৈতিক সমালোচনার শিকার হয়েছে। এমনকি শাহবাজ শরিফের জোট সরকারের শরিকেরাও বাজেটের সমালোচনা করেছেন। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে বলে আশঙ্কা। যে দেশে গত ছয় বছরে আটজন অর্থমন্ত্রী হয়েছেন, সে দেশে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচির জন্য পাঁচ বছর সময় হাতে নেই, দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে করে দেখাতে হবে।’ ফিচ রেটিংসের সূত্রে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস বলছে, ২০২৪ সালে শ্রীলঙ্কা সরকারের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে মোট রাজস্বের ৫৪ শতাংশ, বাংলাদেশের ৩২ শতাংশ, ভারতের ২৮ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ১৫ শতাংশ আর থাইল্যান্ডের ৭ শতাংশ।