জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তিন সদস্য ও এক কমিশনারকে অবসর এবং এক কমিশনারকে বরখাস্ত করেছে সরকার। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এরই মধ্যে অন্য তিন সদস্য ও আট কমিশনারের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে নেমেছে। এতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলনকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।তাদের অভিযোগ, ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় তারা গত ২৯ জুন আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে ফেরেন। কিন্তু সরকার এখন নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের হয়রানি করছে। সরকারের এই অবস্থানে বিব্রত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকা ব্যবসায়ী নেতারা।গতকাল বুধবার এনবিআরের সদস্য কর বিভাগের আলমগীর হোসেন, শুল্কনীতি ও আইসিটি বিভাগের হোসেন আহমদ, মূসক নীতি বিভাগের আবদুর রউফ এবং কমিশনার মো. শব্বির আহমেদকে অবসরে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে শব্বির আহমেদ বরিশাল কর অঞ্চলে কমিশনারের চলতি দায়িত্বে ছিলেন। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে পৃথক চারটি আদেশ জারি করা হয়।আদেশে বলা হয়, চারজনের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪৫ ধারায় চারজনকে অবসরে পাঠিয়েছে। তারা বিধি অনুসারে অবসর সুবিধা পাবেন।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বলা হয়, সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রামের কাস্টম হাউস বন্ধ রাখায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্তে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এ জন্য জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সাময়িক বরখাস্তের সময় তিনি বিধি অনুযায়ী খোরপোশ ভাতা পাবেন।সরকারের অবস্থানের বিষয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ সমকালকে বলেন, লাগাতার শাটডাউনের মাধ্যমে এনবিআরের আন্দোলনকারীরা যেভাবে দেশকে জিম্মি করেছিলেন, তা ছিল নজিরবিহীন। যুদ্ধাবস্থা ছাড়া কখনও বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয় না। কিন্তু এবার তা হয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিও ছিল অযৌক্তিক। এ অবস্থায় দেশের স্বার্থে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবসায়ীরা সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। সরকার আশ্বাস দিয়েছিল, কারও চাকরি যাবে না। কর্মকর্তাদের আমরা এ বার্তা দেওয়ায় আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি হন। কিন্তু এখন সব উল্টো ঘটছে। আমরাও এ অবস্থায় বিব্রত।
আনোয়ার উল আলম আরও বলেন, কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সরকার পরেও ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু তারা শর্তহীনভাবে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। এখন সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া ব্যবসায়ীদের সম্মান সরকার বিবেচনায় রাখতে পারত।গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে এনবিআর বিলুপ্তি রোধসহ কয়েকটি দাবিতে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন করছেন। গত ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশটি সংশোধন করার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এর পর ২২ জুন থেকে চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। ২৮ ও ২৯ জুন কমপ্লিট শাটডাউন এবং মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালিত হয়। চট্টগ্রামের কাস্টম অফিস বন্ধ করে কর্মকর্তারা ঢাকার আন্দোলনে যোগ দেন। এতে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম।এমন স্থবিরতার মধ্যে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় ২৯ জুন রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করে পরের দিন কাজে যোগ দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ওই দিন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সবাইকে সবকিছু ভুলে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে এর পর থেকে আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।এদিকে গত ২৯ জুন প্রথম দফায় এনবিআরের নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম, নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, ঢাকা কর অঞ্চল-৮-এর অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা, ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু এবং বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের বিষয়ে তদন্তে নামে দুদক।
গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফায় এনবিআরের সদস্য মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, সদস্য লুতফুল আজীম, বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট) অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, কর অঞ্চল-১৬-এর উপকরকমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম ও যুগ্ম কমিশনার তারেক হাছানের বিরুদ্ধে দুদক তথ্য অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানান হয়।সরকারের এমন পদেক্ষেপে আতঙ্কিত আন্দোলনকারীরা। ঐক্য পরিষদের ডাকে আন্দোলনে অংশ নেওয়া শীর্ষ তিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের আশ্বাস ও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু এনবিআরের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এখন প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করছে। কেউ কেউ তো বাধ্য হয়ে আন্দোলনে অংশ নেন। এখন তাদের ওপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে এসেছে। সরকারকে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার অনুরোধ জানান তারা।ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, বন্দর বন্ধ করে অর্থনীতিকে জিম্মির আন্দোলন কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না। ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতি উত্তরণে এগিয়ে এলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো কর্মকর্তারা ভুল করেছেন। আন্দোলন প্রত্যাহার করলে তাদের বিষয় সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হবে। এখন সরকার যেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে, আমাদের তো মুখ দেখানোর অবস্থা নেই। এভাবে কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা, তা ভেবে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।