দশ পণ্যে রাজস্ব আহরণে ধসআমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের শুল্ককর যৌক্তিক হতে হবেমেট্রোরেলে ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চায় আইপিডিস্বর্ণালংকারে ভ্যাট কমানোর দাবি বাজুসেরসিগারেটে কর বাড়ানোর আহ্বান এমপিদের
No icon

রিটার্নের সঙ্গে লাগবে না সম্পদ ও ব্যয় বিবরণী

করজাল সম্প্রসারণে কাজ করছে সরকার। কারণ প্রতিবছর করজাল না বাড়িয়ে করহার বাড়ানো হয়। এতে নিয়মিত করদাতাদের ওপর চাপ বাড়ে। এছাড়া প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র করদাতারা কিছুটা ঝামেলায় পড়েন। বিশেষ করে রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী ও ব্যয় বিবরণী নিয়ে। রিটার্ন পূরণ করতে গিয়ে বেশিরভাগ করদাতা ভুল করেন এবং রিটার্ন জমা দিয়ে শেষে সমস্যায় পড়েন। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র করদাতাদের সম্পদ ও ব্যয় বিবরণী জমার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে গ্রস সম্পদ ৪০ লাখ টাকার নিচে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় চার লাখ টাকার নিচে হলে রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী ও ব্যয় বিবরণী জমা দিতে হবে না। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আয়কর আইন সংশোধন করে এ স্বস্তি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কয়েক লাখ শিক্ষক ও ছোট ব্যবসায়ীর মতো প্রান্তিক করদাতারা স্বস্তি পাবেন।

আবার যেসব করদাতা ভবিষ্যতে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে চান, বিনিয়োগ করতে চান, তাদের জন্য এটা বড় সুযোগ বলে মনে করছেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, করদাতা প্রথম থেকে গ্রস সম্পদ এবং ব্যয় সঠিকভাবে দেখালে ভবিষ্যতে সম্পদ আর আয় নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। সরকার করদাতাদের বিরাট একটি সুযোগ করে দিয়েছে।

আয়কর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রস সম্পদ আর জীবনযাত্রার ব্যয়ের সীমা বৃদ্ধির ফলে ছোট করদাতারা স্বস্তি পাবেন। কারণ অনেক ছোট ছোট করদাতা রিটার্ন দাখিল করেন। সম্পদ আর ব্যয় এ দুটি বিষয় রিটার্নে উল্লেখ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। আবার আয়যোগ্য সম্পদ না থাকলেও বিবরণী দিতে হয়। গ্রস সম্পদ আর আয় বিবরণী দিতে গিয়ে অনেক করদাতা বিপাকে পড়েন।

আয়কর আইন, ১৯৮৪ অনুযায়ী ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের আয়কর রিটার্নে সম্পদ বিবরণী (ওঞ ১০ই) এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবরণী (ওঞ ১০ইই) দাখিল করা বাধ্যতামূলক। অর্থবিল, ২০২০ আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ৮০ ধারা সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যেসব করদাতার গ্রস সম্পদ ৪০ লাখ টাকার নিচে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় চার লাখ টাকার নিচে, তাদের আয়কর রিটার্নে সম্পদ বিবরণী এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক নয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একজন স্কুল শিক্ষক। চাকরির সুবাদে তাকে ই-টিআইএন নিতে হয়েছে। প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। এ শিক্ষক প্রথমবার রিটার্নে সম্পদ উল্লেখ করেননি। চাকরি শেষে তিনি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে বাড়ি করলেন। হয়তো ২৫ লাখ টাকা পেনশন পেয়েছেন। বাকি ২৫ লাখ টাকা কোথায় পেয়েছেন, তার সঠিক হিসাব দিতে পারেন না। তিনি হয়তো চাকরির প্রথম থেকে বেতন থেকে অল্প অল্প করে কিছু টাকা ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, কিছু টাকা এফডিআর করেছেন, অথবা কিছু টাকা দিয়ে জমি কিনে রেখেছেন। সেটা বিক্রি করে ২৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রতিবছর রিটার্নে এ সম্পদ উল্লেখ করেননি। সেজন্য শেষ জীবনে তাকে ২৫ লাখ টাকা আয়ের উৎস নিয়ে কর বিভাগের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সেজন্য সম্পদ থাকলে তা রিটার্নে দেখালে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।

সূত্র আরও জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছর আয়কর আইন, ১৯৮৪-এর ধারা ৮০ সংশোধন করা হয়। সে সময় গ্রস সম্পদ ২০ লাখ টাকার নিচে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় তিন লাখ টাকার নিচে হলে রিটার্নে সম্পদ বিবরণী ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছর আবার সংশোধন করে গ্রস সম্পদ ২০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় তিন লাখ টাকা বহাল রাখা হয়।

সংশোধিত আইনে বলা হয়, ২৫ লাখ টাকার ওপরে গ্রস সম্পদ থাকলে, মোটর গাড়ির মালিক হলে, সিটি করপোরেশন এরিয়াতে বাড়ি/ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ করলে তাদের সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে হবে। শেয়ারহোল্ডার ডিরেক্টর ব্যতীত বেতন থেকে, ব্যবসা থেকে ও পেশাগতভাবে আয় করে থাকলে সেই ব্যক্তির যদি তিন লাখ টাকার নিচে জীবনযাত্রার ব্যয় হয়, তাহলে তার ব্যয় বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক নয়।

এনবিআর সূত্র বলছে, অনেক করদাতার বিপুল সম্পদ ও আয় থাকে। কিন্তু ফাঁকি দিতে রিটার্নে গ্রস সম্পদ মূল্য এবং আয় কম দেখান। একসময় তিনি ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, অথবা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। সে সময় রিটার্নে সম্পদের উৎসের বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না বলে তিনি বেকায়দায় পড়েন। কোনো করদাতা রিটার্ন দাখিলের প্রথম থেকে সম্পদ ও ব্যয় সঠিকভাবে দেখালে ভবিষ্যতে ঝামেলায় পড়বেন না।

এনবিআরের আয়করের একজন সদস্য বলেন, ছোট ছোট করদাতা স্বস্তি পাবেন, বিশেষ করে যাদের সম্পদ ৪০ লাখ টাকার নিচে এবং ব্যয় চার লাখ টাকার নিচে। স্কুলশিক্ষক, ছোট ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী প্রভৃতি শ্রেণির বেশিরভাগ করদাতা সম্পদ বিবরণী আর জীবনযাত্রার ব্যয় বিবরণী লিখতে গিয়ে ওলটপালট করে ফেলেন। তিনি বলেন, আবার সম্পদ ও আয়-ব্যয় সঠিকভাবে দেখান না। অনেকেই সম্পদ আর ব্যয়ের সঠিক হিসাব দেখাতে গিয়ে ভয় পান। তবে এসব করদাতাকে এক বিড়ম্বনার শিকার হয়। এখন সম্পদ মূল্যসীমা আর জীবনযাত্রার ব্যয়সীমা বাড়ানো হয়েছে। এসব করদাতা এখন সুযোগ নিতে পারেন।

এ বিষয়ে কর অঞ্চল-১-এর কমিশনার ইকবাল হোসেন বলেন, বিধানটি আগেও ছিল। তবে করদাতারা রিটার্ন সম্পদ আর আয় বিষয় লিখতে গিয়ে ভুল করতেন সঙ্গে বিবরণী দিতে। অনেকেই রিটার্ন তৈরি করতে গিয়ে ঝামেলা পড়তেন। তিনি বলেন, এ বিধান যুক্ত করার ফলে এখন প্রান্তিক ও ক্ষুদ করদাতারা স্বস্তি পাবেন, বিশেষ করে শিক্ষক, গ্রামের ছোট ছোট দোকানদার, যাদের সম্পদ নেই। এর মাধ্যমে করদাতাদের আরও বেশি আস্থা তৈরি হবে, করদাতা বাড়বে।

এ বিষয়ে কর অঞ্চল-১২-এর কমিশনার আবদুল মজিদ বলেন, অনেক করদাতা প্রথম রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে এ ভুল করেন, বিশেষ করে ছোট ছোট করদাতা। সম্পদ ও ব্যয় রিটার্নে ভালোভাবে না লিখে বিড়ম্বনায় পড়েন। পরে এ রিটার্ন নিরীক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়। এখন গ্রস সম্পদ ও ব্যয়সীমা বাড়ানোর ফলে সেই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। তিনি বলেন, সব করদাতার প্রথম থেকে রিটার্নে সম্পদ ও ব্যয় সঠিকভাবে দেখানো উচিত। বিশেষ করে যারা ভবিষ্যতে জমি বা ফ্ল্যাটে কিনবেন বা বিনিয়োগ করবেন। করদাতাদের ভবিষ্যতে যাতে সমস্যায় পড়তে না হয় বা সম্পদ আহরণের উৎস বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্য গ্রস সম্পদ মূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়সীমা বাড়িয়ে সুযোগ দিয়েছে। সব করদাতার এ সুযোগ নেওয়া উচিত।

অপরদিকে আগামী অর্থবছর যাদের ই-টিআইএন রয়েছে তাদের রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে ৫০ লাখ জনের ই-টিআইএন রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯-২০ করবর্ষে রিটার্ন দাখিল হয়েছে প্রায় ২২ লাখ। বাকি ২৫ লাখ জন ই-টিআইএন নিলেও রিটার্ন দাখিল করেননি। বর্তমানে ৩১টি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক। এছাড়া নতুন করদাতা শনাক্তে বছরব্যাপী জরিপ করছে এনবিআর। ফলে আগামী অর্থবছর করদাতার সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে এনবিআর। করদাতাদের কষ্ট লাঘবে এবং করদাতা আকর্ষণে আয়কর রিটার্ন ফর্ম এক পাতা করা এবং অনলাইনে আয়কর প্রদানে দুই হাজার টাকা কর রেয়াত দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।