৩। মূসকের হার, পরিধি, মূসক ব্যবস্থায় ব্যাক্তি ও নিবন্ধন
৩.১। হার ও পরিধি
বাংলাদেশে মূসকের হার হচ্ছে ১৫%। কোনো পণ্য বা সেবা সুনির্দিষ্টভাবে মূসক থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত না হয়ে থাকলে, কোনো নিবন্ধিত ব্যক্তি কর্তৃক বিক্রিত সকল পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে এই হারে মূসক প্রযোজ্য। যে সব পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে ১৫% হারে মূসক প্রযোজ্য নয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে হয় শূন্য হার প্রযোজ্য, নয় তো সেগুলো অব্যাহতিপ্রাপ্ত। অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্য/ সেবা মূসক পরিধির বাইরে রয়েছে।
৩.২। সম্পূরক শুল্ক
মূল্য সংযোজন কর আইনের আওতায় সম্পূরক শুল্ক নামে এক ধরণের কর আদায় করা হয়। কতিপয় পণ্য ও সেবার উপর বিভিন্ন হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা আছে। সাধারণত: অভিজাত পণ্য ও সামাজিকভাবে অনভিপ্রেত পণ্যের উপর সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়। মূসক নিবন্ধিত ব্যক্তি মূসক আদায়ের সাথে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এই সম্পূরক শুল্কও আদায় করে থাকেন এবং মূসক জমা দেয়ার সময় ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে সম্পূরক শুল্কও সরকারী কোষাগারে জমা দিয়ে থাকেন। চলতি হিসাবে ও মূসক রিটার্ণে সম্পূরক শুল্কের হিসাব রাখা হয়। কোনো নিবন্ধিত ব্যক্তি কর্তৃক পরিশোধিত সম্পূরক শুল্ক উপকরণ কর হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় তিনি এই শুল্কের রেয়াত গ্রহণ করতে পারেন না। তবে, পণ্য বা সেবা রপ্তানি করলে উক্ত রপ্তানিকৃত পণ্যের উপকরণের ওপর প্রদত্ত উপকরণ কর সম্পূরক শুল্কসহ (প্রজ্ঞাপনে অনুমোদিত নয় এমন সম্পূরক শুল্ক ব্যতীত) রেয়াত নেয়া যায়।
৩.৩। টার্নওভার কর
টার্নওভার বলতে কোনো ব্যক্তির কোনো নির্দিষ্ট সময়ে করযোগ্য পণ্য বা সেবা সরবরাহের বিপরীতে প্রাপ্ত বা প্রাপ্য মোট অর্থকে বোঝানো হয়।
যে সকল করযোগ্য পণ্য প্রস্তুতকারী বা করযোগ্য সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মূসক নিবন্ধন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা নেই, সে সকল প্রতিষ্ঠান তাদের বার্ষিক টার্ণওভারের উপর ৪% হারে টার্ণওভার কর প্রদান করবে। তবে, কতিপয় পণ্য ও সেবার ওপর টার্ণওভার কর প্রযোজ্য নয় মূসক প্রদান বাধ্যতামূলক।
৩.৪। মূসক ব্যবস্থায় ব্যক্তি
মূসক ব্যবস্থায় ব্যক্তি বলতে স্বাভাবিক ও আইনী উভয় ব্যক্তিকে বাঝানো হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে, ব্যক্তি বলতে বোঝায় একক মালিকানা,পার্টনারশিপ, লিমিটেড কোম্পানী, ক্লাব, অন্যান্য আন-ইনকর্পোরেটেড সংস্থা বা ব্যবসায় পরিচালনার জন্য কান ব্যক্তিবর্গের গ্রুপ।
৩.৫। নিবন্ধন
ব্যবসায় নিয়োজিত যে কোন ব্যক্তির নিজেকেই মূল্যায়ন করতে হবে যে তার মূসক নিবন্ধন গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা আছে কী-না। একজন বসায়ীকে সবার আগে জানতে হবে তিনি যে পণ্য বা সেবার ব্যবসায় করেন তা করযোগ্য কী-না। মূল্য সংযোজন কর, আইন, ১৯৯১ এর প্রথম তফসিলে করযোগ্য নয় এমন পণ্যের এবং দ্বিতীয় তফসিলে করযোগ্য নয় এমন সবার তালিকা রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, সকল প্রকার প্রাথমিক, কৃষিজ, প্রাণীজ পণ্য (মোড়ক বা টিনজাত ব্যতীত) মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যহাতি প্রাপ্ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে পণ্য যেমন- মদ, স্পিরিট, এ্যালকোহল ইত্যাদি উৎপাদনও মূল্য সংযোজন কর এর আওতা বহির্ভূত। সবার ক্ষেত্রে জীবন ধারনের জন্য মৌলিক সেবা, (যেমন- কৃষি জমি প্রস্তুতকারী, সেচ প্রদানকারী, পোকামাকড় ও বালাইনাশকারী, শাক-সবজি, মোড়কাবদ্ধকরণ কৃষি বীজ বিতরণকারী, মৎস্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) সমাজ কল্যাণমূলক সেবা, সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট সেবা, ব্যক্তিগত সেবা (যেমন- সাংবাদিক, অভিনেতা, গায়ক, ক্রীড়াবিদ, নিকাহ রজিস্ট্রার, কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইত্যাদি), সকল প্রকার ধর্মীয় আচার
অনুষ্ঠান, ধর্মীয় স্থান ও স্থাপনার সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত।এছাড়া, সরকার অথবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে আমদানি বা উৎপাদন পর্যায়ে অথবা আমদানি ও উৎপাদন উভয় পর্যায়ে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এমন পণ্য/সেবাও মূল্য জন কর এর আওতা বহির্ভূত। অব্যাহতি প্রাপ্ত সকল পণ্য/সেবা সম্পর্কে জানার লক্ষ্যে নিকটস্থ মূল্য সংযোজন কর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা যেতে পারে। পণ্য/সেবা করযোগ্য না হলে তার নিবন্ধন গ্রহণের প্রয়োজন নেই। তবে, তিনি চাইলে,যেমনটি পরে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বেচ্ছা বন্ধন গ্রহণ করতে পারেন। আবার তিনি যদি করযোগ্য পণ্য বা সেবা সরবরাহ করেন তাহলে নিশ্চিত হতে হবে তার বছরে টার্নওভার বা মোট বিক্রয়ের রিমাণ ৬০ লক্ষ টাকা বা এর বেশী কী-না যদি তা না হয়, সে ক্ষেত্রেও তার নিবন্ধন নেয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে, তাকে টার্নওভার কর এ লিকাভুক্ত হতে হবে অথবা এ ক্ষেত্রেও তিনি ইচ্ছা করলে স্বেচ্ছা নিবন্ধন গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া,কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূলধনী যন্ত্রপাতির মূল্য ২৫ লক্ষ টাকার কম ও টার্ণওভার ৪০ লক্ষ টাকার কম হলে এবং প্রতিষ্ঠানটি লি: কোম্পানী না হলে সে প্রতিষ্ঠানকে মূসকের আওতায় নিবন্ধন গ্রহণ করতে হবে না। এমন প্রতিষ্ঠানকে কুটির শিল্পের আওতায় তালিকাভুক্ত হতে হবে। উল্লেখ্য, কুটির শিল্পের উপর বর্তমানে কোন কর প্রযোজ্য নেই। তবে, প্রজ্ঞাপনে বর্ণীত কতিপয় প্রতিষ্ঠান কুটির শিল্পের বা টার্নওভার করের সুবিধা পাবে না। নিবন্ধিত হওয়ার পর, নিবন্ধিত ব্যক্তিকে তার সকল বিক্রয়ের জন্য মূসক প্রদান করতে হবে, মাসিক দাখিলপত্র/রির্টাণ পেশ করতে হবে এবং আইন ও বিধি অনুযায়ী অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা তিপালন করতে হবে। আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী তিনি উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করতে পারবেন।
নির্ধারিত ফরম মূসক-৬ (পরিশিষ্ট-১) প্রয়োজনীয় দলিলপত্রাদিসহ আবেদনের দুই কার্যদিবসের মধ্যে বিভাগীয় কর্মকর্তা মূসক/ভ্যাট নিবন্ধন নম্বরসহ একটি নিবন্ধনপত্র ইস্যু করে থাকেন। এই নিবন্ধনপত্র বা সার্টিফিকেটটি দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে ব্যবসা অঙ্গনে প্রদর্শন করতে হয়।সরকার অথবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কোনো বিশেষ ধরনের ব্যবসাকে নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারে।
যেসব ব্যবসায়ী কোন করযোগ্য পণ্য বা সেবা সরবরাহ করেন না বা করযোগ্য ব্যবসা করলেও মনে করেন যে তার বার্ষিক টার্ণওভার ৬০ লক্ষ টাকা বা এর বেশী না তারা স্বেচ্ছা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেন। স্বেচ্ছা নিবন্ধন গ্রহণ করলে তাদেরকে মূসক পরিশোধ করতে হবে এবং তাদের উপর আর সব নিবন্ধিত ব্যক্তির মতো দায় দায়িত্ব ও অধিকার বর্তাবে।
ব্যবসায়ীসহ কতিপয় পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে বার্ষিক টার্ণওভার যাই হোক না কেন, মূসক নিবন্ধন গ্রহণ বাধ্যতামূলক। এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের তালিকা (পরিশিষ্ট ২) এ দেয়া হয়েছে।
যে কোনো ব্যক্তিকে তার প্রতিটি স্বতন্ত্র ব্যবসা অঙ্গনের জন্য পৃথক মূসক রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তির যদি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দুইটি ফ্যাক্টরী ও একটি হোটেল থাকে, তবে তাকে তিনটি মূসক নিবন্ধন নিতে হবে। কিন্তু কোনো ট্রেডিং ব্যবসা (উৎপাদন বা প্রস্তুতকরণ ব্যতীত) বা সেবা প্রদান যদি বিভিন্ন স্থানে পরিচালনা করা হয় এবং সকল বিক্রয় কেন্দ্রের যাবতীয় হিসাব কেন্দ্রীয়ভাবে এক জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে ওই ব্যবসায়ী/ সেবা প্রদানকারী জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আবেদন করে একটি মাত্র কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ পেতে পারেন।