কর ফাঁকি দিতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করতে, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে এবং অন্যান্য কারণে পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে অনেকে সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য দেখানো হয় না। এভাবে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং বা কম মূল্য দেখানো এবং ওভার ইনভয়েসিং বা বেশি মূল্য দেখানোর কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের বছরে গড়ে ৭৫৩ কোটি ডলারের গরমিল রয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, এই অঙ্কের উল্লেখযোগ্য অংশ বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হয়ে যেতে পারে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) এক রিপোর্টে এমন প্রাক্কলন করা হয়েছে। জিএফআই গতকাল উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্যসম্পর্কিত অবৈধ অর্থের প্রবাহ (২০০৮-২০১৭) শিরোনামের রিপোর্টে এ বিষয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১৭ সালসহ তিন বছরের পরিসংখ্যান নেই। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও তথ্যের এমন ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের সাত বছরের পরিসংখ্যানকে গড় করে বার্ষিক গরমিলের প্রাক্কলন করা হয়েছে। জিএফআই প্রতি বছর বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। গত বছরের জানুয়ারিতে জিএফআইর রিপোর্টে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচার বিষয়ে বিভিন্ন দেশের ১০ বছরের প্রাক্কলিত পরিসংখ্যান ছিল। এতে উল্লেখ ছিল, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ৫০ হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে পাচার হয়। অন্যদিকে, অন্য দেশ থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসে। জিএফআইর এবারের রিপোর্ট একটু ভিন্ন ধরনের। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিভিন্ন দেশ বছরওয়ারি তার বহির্বাণিজ্যের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, এর সঙ্গে তার বাণিজ্য অংশীদারদের দেওয়া পরিসংখ্যানের বড় অঙ্কের পার্থক্য রয়েছে।
এ থেকে বোঝা যায়, বাণিজ্যের আড়ালে কর ফাঁকি, মানি লন্ডারিংসহ নানা অপরাধ ঘটছে। জিএফআই বলেছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে ৩৬টি উন্নত দেশের মধ্যকার বাণিজ্যে এই মূল্য পার্থক্যের পরিমাণ ৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সর্বশেষ ২০১৭ সালে যার পরিমাণ ৮১৮ বিলিয়ন ডলার। জিএফআই এক সময় বাণিজ্যের পাশাপাশি অন্য উপায়েও অর্থ পাচারের প্রাক্কলন করত। ২০১৪ সাল পর্যন্ত জিএফআইর পরিসংখ্যান সেই কেন্দ্রিক ছিল। ২০১৫ সালের প্রাক্কলনে তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে পাচারের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। জাতিসংঘের কাছে পাঠানো সব দেশের আমদানিকারক ও রপ্তানির তথ্যের মধ্যে গরমিল বা অসামঞ্জস্যতা থেকে জিএফআই অর্থ পাচারের প্রাক্কলন করে। যদিও এর বাইরেও নানা প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়। সেই বিচারে এবারের পরিসংখ্যানকে একটি দেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে অন্য দেশে অর্থ পাচার এবং একই সঙ্গে অন্য দেশ থেকে সেই দেশে পাচার হয়ে আসার মোট পরিমাণকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
জিএফআইর প্রতিবেদনে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল্য পার্থক্যকে একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ইকুয়েডর তার দেওয়া পরিসংখ্যানে যদি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি ডলারের কলা রপ্তানি করেছে বলে উল্লেখ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির পরিসংখ্যানে যদি তা দেড় কোটি ডলার হয়, তাহলে মূল্য পার্থক্য দাঁড়াবে ৫০ লাখ ডলার। এভাবে সব দেশের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য বা মূল্য পার্থক্যের হিসাব করেছে জিএফআই। জিএফআইর রিপোর্টে বলা হয়, উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বার্ষিক বাণিজ্যের ১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ অর্থ আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এই হার ১৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ হাজার ৯৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে আমদানি করেছে ৪ হাজার ৫৪ কোটি ডলারের পণ্য। মোট আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ স্থানীয় মুদ্রায় ৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।মতামত জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, জিএফআইর এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। তবে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচার হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের টাকা মেরে অনেকে কানাডার মতো দেশে অর্থ পাচার করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই অর্থ হয়তো বাণিজ্যের আড়ালে যায়নি। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের প্রবণতা ঠেকাতে কী করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআরের তদারকি আরও বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সব পর্যায়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুটি দেশের পরিসংখ্যানের অমিল শুধু মিথ্যা ঘোষণার কারণেই যে হয়, তা নয়। আমদানি ও রপ্তানির সময়ের পার্থক্যের কারণেও এটি হতে পারে। যেমন : বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্য যখন রপ্তানির উদ্দেশ্যে জাহাজীকরণ হয়, তখন তা কাস্টমস এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই পণ্য যদি ২০ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছায়, তাহলে দুই দেশের রিপোর্টিং সময়ে কিছুটা পার্থক্য তৈরি হয়। সুতরাং কোনো বছরে এ কারণে দুটি দেশের পরিসংখ্যানে কিছুটা পার্থক্য এমনিতেই থাকবে।