প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেশির ভাগ সূচকে পিছিয়ে আছে। তাই বিশেষ প্রণোদনা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আনা সহজসাধ্য হবে না। বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি, করপোরেট ট্যাক্স হ্রাস, দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য সমনীতি প্রণয়ন এবং বিদেশি ঋণ গ্রহণের জটিলতা নিরসনসহ ১৯ দফা সুপারিশ করেছে বিডা। করোনার কারণে সৃষ্ট প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করা হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। করোনাকালে চীন থেকে সরে আসা বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনতে বিডার সদস্য নাভাস চন্দ্র মণ্ডলের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ওই টাস্কফোর্স সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী সংগঠন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী ও খ্যাতনামা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। এছাড়া টাস্কফোর্স ও ইউএনডিপি যৌথভাবে এ বিষয়ে কাজ করেছে। ওইসব বৈঠকের প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনের সুপারিশ আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোয় পাঠায় বিডা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহায়ক রাজনৈতিক পরিবেশ, স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহনশীলতা-এ তিনটি বিষয় বিবেচনায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে থাকে। এগুলোকে হ্রাসকৃত করহার, সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের সহজলভ্যতার চেয়েও বেশি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ইতিবাচক সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের সঙ্গে স্থিতিশীল বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত বছর সেরা ২০টি নীতি সংস্কারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। আরও উন্নতির জন্য বিডা ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এফডিআই (ফরেইন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) আকর্ষণে দেশের ইমেজ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পার্শ^বর্তী দেশ ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারের তুলনায় মাথাপিছু জিডিপি, ব্যবসা সহজীকরণ সূচক, প্রতিযোগী সক্ষমতা সূচক, দুর্নীতির সূচক, করপোরেট ট্যাক্স, শ্রমের মজুরি, মানব-উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। রাতারাতি এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ অবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সহজসাধ্য হবে না, যদি না উদ্যোক্তাদের জন্য উপযুক্ত ফিসক্যাল ও নন ফিসক্যাল প্রণোদনা এবং উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ দেওয়া যায়। বিকল্প হিসাবে স্যামসাং, টয়োটা, সনি, অ্যামাজন, মিটসুবিশি, আলিবাবার মতো বড় ব্র্যান্ড ইমেজসম্পন্ন কোম্পানিকে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করা যেতে পারে। যেমন, ভিয়েতনাম তাদের দেশে বিনিয়োগ করা বড় কয়েকটি কোম্পানিকে সফল ব্যবসার উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করছে।
চার চ্যালেঞ্জ : বিডার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা শুরু হয়। এ কারণে গত বছরের তুলনায় সামগ্রিকভাবে ১০-১৫ শতাংশ বিক্রি কমেছে। আর এ কারণেই নতুন উদ্যোগ আসছে না। এছাড়া অপর্যাপ্ত অবকাঠামো ও লজিস্টিক সহায়তায় ঘাটতি ব্যবসা পরিচালনায় আরেকটি বড় বাধা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি মালামাল খালাসে বেশি সময় লাগে। যানজট ও জটিল খালাস প্রক্রিয়ার কারণে উৎপাদনমুখী শিল্পের কাঁচামাল দীর্ঘ সময় আটকে থাকছে। বিদেশে অর্থ প্রেরণ ও দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণ আরেকটি বাধা। বিদেশে লভ্যাংশ পাঠানোর ক্ষেত্রে জটিল নিয়ন্ত্রক আইন-বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্যবসার শুরুতে বা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিগুলো দ্বিমুখী নীতির সম্মুখীন হয়। যেমন, বিদেশি কোম্পানিগুলো করোনাকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে সহায়তা বা বিদ্যমান ঋণের সুদ মওকুফ সুবিধা পায়নি। উলটো মূল কোম্পানি থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা কেটে রাখে।
সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে-নীতির অনিশ্চয়তা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়। একজন উদ্যোক্তা আর্থিক ও রাজস্ব নীতির ভবিষ্যৎ প্রাক্কলন করতে পারলে নতুন বিনিয়োগ করে থাকেন। অযাচিত ও ঘন ঘন নীতি, প্রণোদনা, নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে।
এছাড়া যে ১৯ দফা সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ক্যাশলেস সোসাইটি বিনির্মাণ, বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি, বিলম্ব বিল পরিশোধের দণ্ড মওকুফ, করপোরেট ট্যাক্স হ্রাস, দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য সমনীতি প্রণয়ন, বিদেশি ঋণের গ্রহণের জটিলতা নিরসন, বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি প্রথা বিলুপ্তকরণ ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা সম্প্রসারণ।
বিডার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সব বন্দরকে আধুনিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত করতে হবে। এতে আমদানি-রপ্তানিতে লিড টাইম কমে আসবে। এছাড়া ওয়ানস্টপ অনলাইন পদ্ধতি চালু করতে হবে। এতে উদ্যোক্তাদের সময়, অর্থ ও অযাচিত শারীরিক উপস্থিতি কমবে। বিলম্বে বিল, আয়কর ও ভ্যাট পরিশোধের দণ্ডসুদ ও জরিমানা মওকুফ করতে হবে। পাশাপাশি কোম্পানি করহারে ছাড় দিতে হবে। কারণ করোনার এবং লকডাউনের প্রভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ও বিক্রয় কমে গিয়েছে। এ অবস্থায় করপোরেট ট্যাক্সে কিছুটা ছাড় দেওয়া হলে ব্যবসা স্বস্তি পাবে। আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত এবং কর অবকাশ সুবিধার মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে।
দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে যাতে সুবিধা পেতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে মূল কোম্পানি থেকে স্বল্প সুদে ঋণ গ্রহণে সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা তারল্য সংকট মোকাবিলা করতে পারে। ইপিজেডে অবস্থান সব কারখানার মজুরি বৃদ্ধি প্রথা স্থগিত রাখতে হবে। বর্তমানে প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির নিয়ম রয়েছে। সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে নীতি গ্রহণ করতে হবে। যদি শুধু করোনাকে কেন্দ্র করে নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে তা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না। একই সঙ্গে বিদ্যমান নীতির সংস্কারে মনোযোগী হতে হবে।
পাশাপাশি বন্দরের চাপ কমাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা সম্প্রসারণ করার কথা বলা হয় প্রতিবেদনে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পের বন্ডেড সুবিধা সম্প্রসারণ করা হলে লিড টাইম কমবে। এছাড়া করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের তালিকা করতে হবে। এ সংক্রান্ত তালিকা বানানো হয়। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকে নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে না। প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি প্রণোদনা দিতে হবে। প্রতিযোগী দেশগুলো বিনিয়োগ আকর্ষণে উচ্চ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে নতুন করে প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম এফডিআই এসেছে, ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এশিয়ার দেশগুলোয় সিঙ্গাপুর, চায়না, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও জাপান থেকে এফডিআই গিয়েছে। এসব দেশের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণে রোড শো, মেলা, সেমিনার করা যেতে পারে। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, চায়না/হংকং, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে টার্গেট করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক (পিআরআই) ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, শুধু প্রণোদনা দিয়েই বিদেশি বিনিয়োগ আনা যাবে না। মূল সমস্যাগুলো দূর করতে হবে। অবকাঠামো উন্নয়ন করে দেওয়াও এক ধরনের প্রণোদনা। বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অত্যাধুনিক সরঞ্জাম স্থাপন করাও প্রণোদনার অংশ। এসব করা হলে তা টেকসই প্রণোদনা হবে। তাছাড়া নগদ প্রণোদনা দিলে তা শুধু জনগণের টাকা খরচ করাই হবে। তিনি আরও বলেন, ঢালাওভাবে প্রণোদনা দেওয়া হলে তা এলডিসি উত্তরণে সমস্যা হতে পারে। তখন রপ্তানি বাড়াতে কৃত্রিমভাবে সহায়তার অভিযোগ উঠতে পারে। তাই সরকারের উচিত, টেকসই প্রণোদনার জন্য মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করা। সুশাসন নিশ্চিত করে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর কাজ শেষ করা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার অযাচিত প্রতিবন্ধকতাগুলোকে চিহ্নিত করে তা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
আরেক অর্থনীতিবিদ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, প্রণোদনা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আনা যাবে না। আর দীর্ঘমেয়াদে তা কাজেও আসবে না। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রণোদনার চেয়ে প্রতিযোগী সক্ষমতা, রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক ও নীতির ধারাবাহিকতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। বিডার টাস্কফোর্স যেসব সুপারিশ করেছে, তা সাধারণ ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগ ধরতে সুপরিকল্পতিভাবে বিনিয়োগ আকর্ষণ কৌশল ঠিক করতে হবে। কোনো ধরনের শিল্প বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা আছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করতে হবে।