দেশে ডলার সংকটের কারণে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সব খাতেই নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে কমেছে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে একদিকে জনজীবনে চরম ভোগান্তি বেড়েছে।
অন্যদিকে নতুন শিল্প স্থাপন, শিল্পোৎপাদন, কৃষি উৎপাদন, বাণিজ্যিক পণ্যের সরবরাহ ও কর্মসংস্থানের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ‘শাঁখের করাতে’ পরিণত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হলেও দীর্ঘ সময় তা অব্যাহত রাখায় এখন উলটো মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়েছে। এতে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নতুন সংকটের সূচনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার আগেই ব্যাংকিং খাত, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মন্দা ছিল। ২০২০ সালের শুরুতে করোনার সংক্রমণ সারা বিশ্বে ছাড়িয়ে পড়লে অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বেশির ভাগ স্থবির হয়ে পড়ে। ওই বছরে করোনা প্রতিরোধী বিভিন্ন উপকরণ বেশি আমদানি হলেও সার্বিক আমদানির এলসি খোলা কমে যায় ১০ শতাংশ। করোনা সংক্রমণ কমার পর ২০২০-২১ অর্থবছরে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যায়, অন্যদিকে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়।
এতে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে ওই অর্থবছরে অর্থের হিসাবে আমদানির এলসি ২০ শতাংশ বাড়লেও পরিমাণগতভাবে কমে যায়। করোনার ক্ষত কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০২১-২২ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এতে পণ্যের সরবরাহ আরও বাধাগ্রস্ত হয় ও দাম বেড়ে যায়। ওই সময়ে আমদানির এলসি বেড়েছিল ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত দুই অর্থবছর পণ্যের বাড়তি দামের কারণে বেশি অর্থ খরচ করে কম পণ্য আমদানি করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে এলসি কমেছে ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল ৮ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গড়ে গত চার বছর ধরেই আমদানি কমছে। মে-জুনে আরও কমতে পারে। কারণ সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। তারা রিজার্ভ ধরে রাখতে চাচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যাংকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাবদ যে ডলার আসছে তা দিয়ে আমদানি ব্যয়ও মেটানো যাচ্ছে না।
ফলে অনেক ব্যাংকই এখন এলসি খুলতে পারছে না। বিশেষ করে যাদের ডলার আয় আছে অর্থাৎ রপ্তানিকারকরাই এখন চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারছেন। যাদের ডলার নেই তারা শতভাগ মার্জিন দিয়েও এলসি খুলতে পারছেন না। এভাবে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া সব খাতে আমদানি কমে যাচ্ছে।
এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে ভোগ্যপণ্যের ১৮ শতাংশ, শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালে ৩১ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামালের ৩২ শতাংশ, শিল্পের যন্ত্রপাতির ৬০ শতাংশ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ৪৬ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে এলসি খোলা কমেছে ২০ শতাংশ। শুধু জ্বালানি তেল আমদানির এলসি বেড়েছে আড়াই শতাংশ ও কয়লার এলসি বেড়েছে ২৮ শতাংশ। গ্যাসের আমদানিও কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়ায় একদিকে আমদানি খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে আমদানির পরিমাণ কমেছে।
চাহিদা অনুযায়ী এসব পণ্য আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। একদিকে প্রচণ্ড দাবদাহ, অন্যদিকে লোডশেডিং ও পানির সংকট-এই তিনে মিলে জনজীবনে চরম ভোগান্তি নেমে আসে। তবে গত দু’দিনের বৃষ্টিতে ভোগান্তি কিছুটা কমেছে। একই সঙ্গে শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদনে বড় বিপর্যয় নেমে আসে। বৈশ্বিক মন্দায় রপ্তানির আদেশ কমে যায়। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৩৫ শতাংশ। আগামীতে রপ্তানিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শিল্প বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বেশি দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ চেয়েছিলাম। সেটি মিলছে না। এতে শিল্পের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বড় শিল্পগুলো এখন কোনো রকমে টিকে আছে। ছোট শিল্প এখন বড় সংকটে। এ অবস্থা যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে ক্ষতি তত বেশি বাড়বে। ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন নতুন সংকট দেখা দেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে আমদানি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ শতাংশ। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে গত জুলাই-এপ্রিল সময়ে কমেছে সাড়ে ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ বেশি কমেছে। এতে ডলার কিছুটা সাশ্রয় হলেও আমদানিনির্ভর শিল্পগুলোর সঙ্গে জড়িত কর্মসংস্থান যেমন কমেছে, সরবরাহ সংকটে পণ্যের দামও বেড়েছে। ফলে আমদানি কমানোর দায় এখন ভোক্তার কাঁধে চেপেছে দুইভাবে। একদিকে তাদেরকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে আয় কমেছে, নতুন কর্মের বাজার সংকুচিত হয়েছে। বেকারদের চাকরি মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলার সংকটের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে অর্থনীতিতে নতুন সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আমদানি কমায় পণ্যের সরবরাহ কমে গেছে, বেড়েছে দাম। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে মূল্যস্ফীতির হার কমানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আমদানি কম হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়তে থাকবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় গত বছরের মার্চে আমদানি সর্বোচ্চ এলসি খোলা হয়েছিল ৯৫১ কোটি ডলার। এর আগে ওই অর্থবছরে পরপর চার মাসে এলসি খোলা ৮০০ কোটি ডলারের উপরে উঠেছিল। মার্চে আমদানি বাড়ার পর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ওই বছরের ১১ এপ্রিল প্রথম ২৫ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। পরে একে আরও বাড়িয়ে বিলাসী পণ্যে শতভাগ করা হয়। শুল্ক বাড়ানোসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রণও আরোপ করা হয়। ফলে এপ্রিলে আমদানি কমে ৮৪১ কোটি ডলারে নামে। মে মাসে ৬৯৬ কোটি ডলার এবং জুনে ৭০২ কোটি ডলারে নামে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই আগস্টে তা আরও কমে ৬০০ কোটি ডলারের মধ্যে ছিল। অক্টোবরে নেমে আসে ৫০০ কোটি ডলারের ঘরে। নভেম্বরে আরও কমে ৪৭৫ কোটি ডলারে নামে। রোজা ও ঈদের কারণে ডিসেম্বর থেকে এলসি খোলা আবার বাড়তে থাকে। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৫০০ কোটি ডলারের ঘরে এলসি খোলা হয়েছিল। এপ্রিলে আরও কমে ৪৩০ কোটি ডলারে নামে। মন্দার মধ্যে এখন তা সর্বনিম্ন।