দেশে উৎপাদিত প্রসাধনীতে করের বোঝা, আমদানিতে ছাড়ভোজ্যতেল আমদানিতে কমলো ভ্যাটখেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশঅনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল ও নিবন্ধন করবেন যেভাবেনবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া হচ্ছে ১০ বছরের কর অব্যাহতি
No icon

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো রপ্তানির নতুন হিসাবে বড় পরিবর্তন

বাংলাদেশ ব্যাংক দুই অর্থবছরের ২০ মাসে রপ্তানি আয়ের ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার উধাও হয়ে যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে। এই সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানির নতুন যে হিসাব দিয়েছে, তাতে এই বড় পরিবর্তন এসেছে। রপ্তানির হিসাবে বড় পরিবর্তন হওয়ায় ওলট-পালট হয়ে গেছে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি ও আর্থিক হিসাব। দেশের অন্য হিসাবও বদলে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

রপ্তানির হিসাবে পরিবর্তন এবং লেনদেন ভারসাম্যের চলতি ও আর্থিক হিসাব ওলট–পালট হওয়ার কারণে এখন দেশের আর্থিক খাতের নানা তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বছরের পর বছর করছাড় ও প্রণোদনা দিয়ে টিকিয়ে রাখা রপ্তানি খাতের অবদান নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। কথা উঠেছে, রপ্তানিকারকেরা ডলার আয় করছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন, এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। 

রপ্তানিকারকেরাও অবশ্য দুই বছর ধরে বলে আসছেন, রপ্তানি কমছে। ব্যাংকগুলোও আমাদের জানিয়েছিল, রপ্তানি আদেশ কমে গেছে। এরপরও সরকারি সংস্থা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানিতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির গালগল্প শুনিয়েছে এবং সে রকম তথ্যই প্রকাশ করেছে। এর ভিত্তিতে সরকারের মন্ত্রীরাও রপ্তানি খাতে ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সেই তথ্যের ওপর ভর করে আর্থিক হিসাব-নিকাশ করেছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক জানত, রপ্তানি যতটা বলা হচ্ছে, ততটা হচ্ছে না। কারণ, প্রতিবছর রপ্তানি আয় ৪–৫ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি থেকে ৫০০ কোটি ডলার কম আসছিল। এই প্রবণতা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে ওঠে। ২০২২ সালে দেশে ডলারের সংকট শুরু হওয়ার পর নিট ট্রেড ক্রেডিটে ঘাটতি বড় আকার ধারণ করে। এতে আর্থিক হিসাব দীর্ঘদিন পর ঘাটতিতে পড়ে যায়। আর্থিক হিসাবে প্রকৃত ট্রেড ক্রেডিট বলতে রপ্তানি (শিপমেন্ট) ও রপ্তানি আয়ের পার্থক্য এবং আমদানি (শিপমেন্ট) ও আমদানি ব্যয়ের পার্থক্যের যোগফলকে বোঝানো হয়। এতেই টনক নড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এরপর তিন সংস্থার মধ্যে একাধিক সভার পর নতুনভাবে হিসাব করা শুরু হয়।

প্রতিবছর রপ্তানি ও রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনে যখন ৪–৫ বিলিয়ন ডলার (দেশি মুদ্রায় ৪৬ হাজার ৮০০ থেকে ৫৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা) ঘাটতি হয়েছিল, তখনই যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনকার মতো উদ্যোগ নিত, তাহলে পার্থক্যটা এত বড় হতো না। বাংলাদেশ দুই বছর ধরে আর্থিক হিসাবে ঘাটতির দায় মাথায় নিয়ে যে চলছে, তা–ও হয়তো চলতে হতো না। আসলে প্যান্ডোরার বাক্স সময়মতো খুলতে চায়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, এটা খুলে গেলে আরও কত কিছু বের হয়ে আসার আশঙ্কা ছিল।

<iframe frameborder="0" height="1" id="google_ads_iframe_85406138/mCanvas_1x1_2" name="google_ads_iframe_85406138/mCanvas_1x1_2" scrolling="no" title="3rd party ad content" width="1"></iframe>

গ্রিক পুরাণমতে, পৃথিবীর প্রথম নারী প্যান্ডোরাকে একটি বাক্স উপহার দিয়েছিলেন দেবতারা। তবে বাক্সটি খুলতে নিষেধ করেছিলেন। উৎসুক প্যান্ডোরা একদিন বাক্সটি খুলে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অশুভ শক্তি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীজুড়ে। সে অনুযায়ী প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মানে হলো, এমন একটি প্রক্রিয়া, যা একবার শুরু হলে অনেক জটিল সমস্যা তৈরি করে।

শুধু ২০ মাসেই রপ্তানি আয়ে ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের ঘাটতি উদ্‌ঘাটনেই যে জটিলতার সমাধান হবে, বিষয়টি তেমন নয়। দিন যত যাবে, পুরো হিসাব তত বের হবে। অর্থাৎ দেখা যাবে যে দিন যত যাচ্ছে, তত খারাপ খবর আসছে। এ জন্য ডলার–সংকট কাটছে না। ডলার ও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে দিনে দিনে মানুষের জীবনের কষ্ট বাড়াচ্ছে।

ডলার–সংকটের অন্যতম নেপথ্য কারণ হলো, পণ্যের রপ্তানি মূল্য ও রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসনে বড় পার্থক্য রয়েছে। রপ্তানিকারকেরা ডলার খরচ করে কাঁচামাল এনেছেন ঠিকই, কিন্তু তা দিয়ে তৈরি পণ্য রপ্তানির টাকা সেভাবে দেশে আনছেন না। একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির মালিকানাধীন গ্রুপই তো ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় দুবাই ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে আটকে রেখেছে। এ নিয়ে কেউ কিছু করছেন না। অর্থ পাচার প্রতিরোধে সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নামক সংস্থাটিরও চরম উদাসীনতা রয়েছে।

হিসাব কষলে দেখা যাবে যে শুধু রপ্তানি নয়, আমদানি ব্যয়ের যে হিসাব দেখানো হয়, সেই পরিমাণে দেশে পণ্য আসেনি। দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা তো আরও নাজুক। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ যা বলা হচ্ছে, প্রকৃত খেলাপি তার চেয়ে অন্তত তিন গুণ বেশি বলে ধারণা করা হয়। ফলে ব্যাংকের মূলধন, নিরাপত্তা সঞ্চিতিসহ কোনো হিসাবই ঠিক নেই। কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখতে তাদের স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংকই মাঝেমধ্যে বিনা জামানতে ৩০-৪০ হাজার কোটি টাকা ধার দিচ্ছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত থেকে ডলার দিয়েও ফেরত পাচ্ছে না, আবার কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না।

কিছু ব্যাংকের মালিক, ঋণখেলাপি খুবই প্রভাবশালী ও মহাক্ষমতাধর। এ জন্য কেউ তাঁদের খোঁজ নেয় না। ফলে তাঁদের কোনো নিয়ম মেনে চলতে হয় না। অথচ আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজগুলোর একটি। এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি এখন উল্টো আচরণ করছে। তদারকির অভাবে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা না পাওয়ার ঘটনাও এখন প্রকাশ্য।