বাড়বে ভ্যাট, বাড়তি দামের চাপে ভুগতে হবে ভোক্তাদের। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ দাম বাড়াচ্ছে পাইপেরমেট্রোরেলের ভাড়ায় বসছে ১৫% ভ্যাটকৃষি ও নিত্যপণ্যে শুল্ক না বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকরছাড় কমাতে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী
No icon

গরিবের বাজেট বনাম গরিব মারার বাজেট

এ কথা কারোরই বোধহয় অজানা নয়, যখনই বাজেট সামনে আসে কিংবা জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করা হয়, তখন ধরে নেয়া হয় সরকারি দলের পক্ষে একটি মিছিল বা সমাবেশ হবে, যেখানে বলা হবে গরিবি হটানো বা দারিদ্র্যমুক্তির বাজেট। আর আরেকটি পক্ষ, যারা বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত, সংসদে থাকুক বা না-ই থাকুক, তারা সরকারি দলকে চাপের মধ্যে রাখার জন্য লিখবে গরিব মারার বাজেট। সেক্ষেত্রে গরিব মানুষ বাংলাদেশের বাজেট রাজনীতি তথা সামগ্রিক রাজনীতির বড় বিষয় হয়ে উঠেছে। বাজেটে দুটি বিষয় থাকে। এক. উন্নয়ন বাজেট এবং দুই. রাজস্ব বাজেট। উন্নয়ন বাজেটে যেসব বিষয় থাকে, সেগুলো মূলত গরিবি হটানোকেন্দ্রিক। যিনিই অর্থমন্ত্রী থাকুন না কেন, যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ে সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছেন এবং আমাদের বাজেট ব্যবস্থাপনা অনেকটাই উন্নয়ন সহযোগীদের উপদেশের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়, সেক্ষেত্রে দারিদ্র্য কমানো-হটানো, সামাজিক বণ্টন ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন বাজেটের বিরাট ক্ষেত্র দখল করে রাখে।

অর্থনীতির একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে মনে করি, বাজেট কখনো গরিব মারার বাজেট হতে পারে না; বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো বিকাশমান বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোয়। সেক্ষেত্রে বাজেট প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের সময় আমরা যদিও গরিব মানুষকে ভুলে যাই না, কিন্তু কিসে গরিব মানুষের উপকার হবে, পুরনো ধাঁচের বিপরীতে নতুন ধাঁচে বাজেট প্রণয়ন ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন আনলে গরিবি হটানোর মাধ্যমে গরিব লোকটির হাতে অধিকন্তু কিছু টাকা দেয়া যাবে, যাতে সে শিক্ষা, স্বাস্থ্য কিংবা অন্য চাহিদাগুলো মেটাতে পারে, তা ভুলে যাই। সে কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যদিও গরিবি হটানোর ক্ষেত্রে এনজিওগুলো গ্রামাঞ্চলে ভালো কাজ করেছে, তবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে খুব একটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এমনকি আমাদের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়ও আমরা গতানুগতিক ধারার বাইরে যেতে পারছি না।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্রটি আমরা সামনে আনি। আমাদের দেশের প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তার মধ্যে ১২ শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র। অতিদারিদ্র্য কমানো যাচ্ছে না কেন? আমরা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর অধীনে প্রতি বছর বেশকিছু টাকা বরাদ্দ রাখছি, খরচ করছি। সেটি হয়তো ঠিকই কিছুটা কাজেও লাগছে। তা না হলে আমরা আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে রংপুর বিভাগে যে মঙ্গার কথা শুনতাম, এখন সেটি শোনাই যাচ্ছে না বলা চলে। এর প্রধান কারণ বিভিন্ন প্রকল্প। এজন্য আমরা মঙ্গা বা আঞ্চলিক দারিদ্র্য কম শুনতে পাচ্ছি। তথাপি বাংলাদেশে বাজেটের বাস্তবায়ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এখনো কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি হলো, সত্যিকারের প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে না, যেটি আমাদের প্রত্যক্ষ সুফল দেবে এবং স্বাভাবিকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শুধু উদ্ধার করবে না, তাদের যেন স্থিতিশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয়ত, আমরা যদি স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় দেখি তাহলে দেখব আমাদের গ্রামাঞ্চল, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক মহোদয় তথা সদাশয় সরকার যে দায়িত্বটি পালন করছেন, সেটি মূলত প্রেসক্রিপশন লিখে দেয়ার। বিভিন্ন পর্যালোচনায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৭৭ শতাংশ স্বাস্থ্য ব্যয় রোগীকে নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়, যা এশিয়ায় সর্বোচ্চ। তেমনটি শিক্ষা ব্যবস্থায়ও। গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান আমরা বাড়াতে পারিনি কিংবা একটি স্থিতিশীল জায়গায় আনতে পারিনি। সেক্ষেত্রে স্কুলে যাওয়ার পরেও কৃষকের ছেলেকেও কোচিং করতে হচ্ছে। সেজন্য ন্যূনতম পড়ালেখার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তার নিজ পকেট থেকে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ অর্থ সরকার বিনা মূল্যে বই দেয়ার পরেও ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে আমরা কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পাচ্ছি না। কাজেই গরিবকে শুধু অতিদারিদ্র্য থেকে বের করলে হবে না, গরিবিপনার প্রক্রিয়া থেকে বের করতে হবে। সেক্ষেত্রে তার কিছু উদ্বৃত্ত পুঁজি (সারপ্লাস ক্যাপিটাল) সৃষ্টি করতে হবে। সেই পুঁজি সৃষ্টি হচ্ছে না। কারণ তার ব্যয়ের বিপুলাংশ চলে যাচ্ছে পরিবার-পরিজনের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবায়। উদ্বৃত্ত পুঁজি সৃষ্টি করতে হলে তাকে ধানের পাশাপাশি পোলট্রি খামার, পশুপালন ও সবজি চাষ করতে হবে। তদুপরি ফসলের উচ্চ মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। নিজের পকেট থেকে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ আপদ মোকাবেলার ব্যয় কমাতে হবে।

তাছাড়া আরেকটি যে বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে তা হলো, আঞ্চলিক বৈষম্য। সেক্ষেত্রে ঢাকা হয়ে যাচ্ছে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। ফলে ন্যূনতমভাবেও যদি কেউ সন্তানদের লেখাপড়া করাতে চান কিংবা স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে হয় জেলা সদরে নতুবা বিভাগীয় শহর এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঢাকায় চলে আসতে হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুটি শহরের মধ্যে যে আমাদের কনসেনট্রেশন হয়েছে, তার মধ্যে বেশির ভাগই ঢাকা শহরে, এতে গরিব মানুষের বাড়তি আয় চলে যাচ্ছে।

আমি মনে করি, গরিব মারার বাজেট ঠিক নয়। আবার গরিবের বাজেট এটিও ঠিক নয়। কারণ গরিব মারার বাজেট কেউ করতে চায় না। পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চাওয়া সরকার যদি ২৫ শতাংশ ভোটও পেতে চায়, তাহলে আমার মনে হয় না ২০-২৫ শতাংশ দরিদ্র লোককে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের উদ্যোগগুলো কিংবা সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা অন্য যে অনুদান দেয়া হচ্ছে, সেগুলোকে কার্যকর করতে হবে। এখন সেগুলো হয় তাদের কাছে পৌঁছতে পারছে না কিংবা তাদের জন্য অন্য কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ করা যাচ্ছে না। এমনকি সেগুলো হয়তো মৌসুমি সমস্যা সমাধান করছে, দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সমাধান করছে না।

আগে উল্লেখ করেছি, আমাদের বাজেট গরিব মারার বাজেট নয়, আবার গরিবের বাজেটও হতে পারছে না। সেক্ষেত্রে আমাদের বাজেটারি পদ্ধতিতে নতুনত্ব আনার পাশাপাশি বাজেটের বণ্টনে যেমন অভিনবত্ব আনতে হবে, তেমনি বণ্টনকৃত অর্থের সদ্ব্যবহার হচ্ছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। সার্বিকভাবে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর এবং গ্রাম ও শহরে যে ব্যবধান রয়েছে, সেটি বাজেটারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক