
যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর শুধু নিবন্ধন দিয়েই বসে থাকে। ফলে নিবন্ধন নিয়ে হাজার হাজার কোম্পানি হয়ে আছে শুধু কাগুজে কোম্পানি। এসব কোম্পানি ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করল কি না, ব্যবসা শুরু করল কি না, পরিচালকদের ব্যবসা পরিচালনায় সক্ষমতার কোনো খোঁজ নেন না আরজেএসসির কর্মকর্তারা।
কয়েক মাস আগে আরজেএসসির সহায়তায় অস্তিত্বহীন প্রায় ৮০ হাজার কোম্পানির খোঁজ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিশেষ টাস্কফোর্স। যদিও এসব কোম্পানির কোনো কার্যালয় ওই দুটি ভবনে নেই। অস্তিত্বহীন এসব কোম্পানি চিহ্নিত করতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে আরজেএসসি। কিন্তু কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি সংস্থাটি। তবে কোম্পানিগুলোকে টিআইএন দিচ্ছে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর কার্যালয়।
আরজেএসসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বর্তমানে ১ লাখ ৮৬ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানির নিবন্ধন, রিটার্ন জমা তদারক, সার্বিক পরিচালনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য মাত্র ৬ জন পরিদর্শক রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা কার্যালয়ে পাঁচজন এবং রাজশাহী কার্যালয়ে একজন পরিদর্শক আছেন। চট্টগ্রাম ও খুলনা কার্যালয়ে কোনো পরিদর্শক নেই। তবে পরিদর্শক-সংকটের কারণে আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া তথ্য এবং কোম্পানির প্রস্তাবিত ঠিকানা সরেজমিনে যাচাই-বাছাই ছাড়াই নিবন্ধন দেওয়া হয়। শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরে কোম্পানি নিবন্ধন নেওয়া ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
আরজেএসসির নিবন্ধক শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, সরেজমিন যাচাই-বাছাই করে কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়ার মতো লোকবল নেই। তাই আবেদনপত্রের কাগজপত্র ঠিক থাকলেই নিবন্ধন দেওয়া হয়। নিজেদের দুর্বলতার কথা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, একই ঠিকানা ব্যবহার করে শত শত কোম্পানির নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
লোকবল ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে যাচাই-বাছাই না করেই নির্বিচার কোম্পানি নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। তিনি মনে করেন, বছরে হাজার হাজার কোম্পানি নিবন্ধন নিচ্ছে, নিবন্ধন নেওয়ার পর সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা দেখভাল করার দায়িত্বও আরজেএসসির। তারা এই দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
আরজেএসসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নামের ছাড়পত্র পাওয়া গেলে কোম্পানির জন্য আবেদন করা হয়। প্রস্তাবিত কোম্পানির ঠিকানা, পরিচালকদের কর শনাক্তকরণ নম্বরসহ (টিআইএন) বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র দিতে হয়। এসব কাগজপত্র ভুয়া কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় না বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া বেশি কোম্পানি নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নেন উদ্যোক্তারা।
ভবিষ্যতে কাঙ্ক্ষিত নামে কোম্পানির নামের ছাড়পত্র না-ও পাওয়া যেতে পারে, এ আশঙ্কায় অনেকে কোম্পানির নিবন্ধন নিয়ে বসে থাকেন। নিবন্ধন নেওয়ার পর টাকা জোগাড় করতে না পেরে অনেকে কোম্পানি চালু করেন না।
গত দেড় বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন বিনিয়োগেও তেমন আগ্রহ নেই উদ্যোক্তাদের। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। যৌথ মূলধনি ও কোম্পানিসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ হাজার ১২৫টি কোম্পানি নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ২১০টি কোম্পানিকে আবেদন করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
গত অর্থবছরে প্রতিদিন গড়ে ৪৯টির বেশি কোম্পানিকে নিবন্ধন দিয়েছে আরজেএসসি। সর্বশেষ হিসাবে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে মোট ১ হাজার ৩৬৫টি কোম্পানিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা বা শিল্পগোষ্ঠী সহযোগী কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নিয়ে রাখলেও উৎপাদন বা পরিচালনায় যায় না বলে জানা গেছে।
বিলম্ব মাশুল দিয়ে রিটার্ন দেওয়ার আইনি সুযোগ থাকায় অনেক কোম্পানি মালিক নিয়মিত রিটার্ন দেন না। অনেক উদ্যোক্তা কোম্পানি নিবন্ধন নিলেও পরে আর তা চালু করেননি। ফলে এসব কোম্পানি কাগুজে হয়ে গেছে।
আরজেএসসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গত জুন মাস পর্যন্ত দেশে এক লাখ ৮৬ হাজার ৮২৫টি প্রাইভেট কোম্পানি আছে। সবার প্রতিবছর বার্ষিক রিটার্ন দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৪০ শতাংশ বা ৭৪-৭৫ হাজার কোম্পানি নিয়মিত রিটার্ন দেয়। এই সংখ্যা কখনো কখনো ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। বাকি এক লাখ কোম্পানি রিটার্ন দেয় না।
আরজেএসসির নিবন্ধক শেখ শোয়েবুল আলম বলেন, বিলম্ব মাশুল দিয়ে রিটার্ন দেওয়ার আইনি সুযোগ থাকায় অনেক কোম্পানি মালিক নিয়মিত রিটার্ন দেন না। অনেক উদ্যোক্তা কোম্পানি নিবন্ধন নিলেও পরে আর তা চালু করেননি। ফলে এসব কোম্পানি কাগুজে হয়ে গেছে। আইনি জটিলতার কারণে আমরাও ব্যবস্থা নিতে পারি না।
কোম্পানির নিবন্ধন নেওয়ার পর কত দিনের মধ্যে পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করতে হবে, সে বিষয়ে আইনি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতিবছর রিটার্ন বা বার্ষিক বিবরণী জমা দেওয়ার কথা থাকলেও আইনি ফাঁকফোকরের কারণে অনেক কোম্পানি নিয়মিত রিটার্ন দেয় না। নিয়ম অনুযায়ী কোনো কোম্পানি যদি বার্ষিক বিবরণী আরজেএসসিতে জমা দিতে না পারে, তাহলে প্রথম তিন বছরে প্রতিবছরের জন্য ৫০০ টাকা এবং ৩ বছর পর প্রতিবছরের জন্য ৭০০ টাকা বিলম্ব মাশুল আরোপের বিধান রয়েছে।