ধনী-গরিবের বৈষম্য কমাতে সম্পদের ওপর যৌক্তিক হারে কর আরোপ সময়ের দাবি। বর্তমানে নগদ অর্থ বা আর্থিক বিনিয়োগসহ অস্থাবর সম্পদের ওপর কর আদায়ের ব্যবস্থা থাকলেও স্থাবর সম্পদের ওপর কর আদায়ের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। উন্নত দেশে প্রত্যক্ষ করের ১০ শতাংশ আসে সম্পদ কর থেকে, বাংলাদেশে যা আধা শতাংশও নয়। তবে রাজস্ব আয় বাড়াতে গিয়ে সম্পদের ওপর এমন হারে যাতে কর নির্ধারণ করা না হয়, যার কারণে করদাতা ভয় পেয়ে যান বা কর দিতে নিরুৎসাহিত হন।বুধবার গবেষণা সংস্থা সিপিডি আয়োজিত বাংলাদেশে সম্পদ করের অবস্থা ও আহরণের সুযোগ শীর্ষক এক সংলাপে বক্তারা এমন মত দেন। সংলাপ সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।সংলাপে বক্তারা বলেন, রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হবে। আবার কর নির্ধারণ যাতে সরকারি কর্মকর্তার স্বেচ্ছাধীন না থাকে। সম্পদমূল্য ও কর নির্ধারণের স্বচ্ছ পদ্ধতি করতে হবে।
রাজধানীর লেকশোর হোটেলে আয়োজিত সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সরকার কর আদায়ে নানামুখী সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ভূমিকর আদায়ে পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যা চালু হয়েছে গত ১৪ এপ্রিল। এর পর গত এক মাসে ভূমিকর আদায় হয়েছে ৩২৬ কোটি টাকা। যেখানে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পুরো বছরে ৬২১ কোটি টাকা কর আদায় হয়েছিল। ম্যানুয়াল পদ্ধতির সঙ্গে কিছুটা অনলাইন ব্যবস্থা প্রচলনের পর ২০২১-২২ অর্থ বছরে কর আদায় বেড়ে ৭৯১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।জমি বিক্রি না হলে বা ক্যাপিটাল গেইন না আসা পর্যন্ত তার ওপর বাজারমূল্যে সম্পদ কর আদায় করা অন্যায্য হবে বলেও মত দেন ভূমিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার বাবা বহু বছর আগে গুলশানে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকায় জমি কিনেছিলেন। ওই জমির মূল্য এখন অনেক। এখন বিক্রি করা না হলে কর নেওয়া কী যৌক্তিক হবে? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, মন্ত্রী সাহেব নিজের দিক বিবেচনা করে কথা বলছেন। আসলে সরকারকে সবার দিক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। রাতারাতি সব পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
মূল প্রবন্ধে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সমাজে বৈষম্য কমাতে সম্পদ কর আরোপের বিকল্প নেই। তবে তা অবশ্যই ন্যায্যতা, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে।তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই ভূমিকর দেয় না। এক সময় পণ্য আমদানিতে সরকার আমদানি শুল্ক দিত না, এখন দেয়। এভাবে ভূমির ওপরও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, বর্তমানে আদায় করা করের দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ কর। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে সম্পদ কর কতটুকু তা বলা কঠিন, তবে ৪ শতাংশের বেশি নয়। সম্পদ থেকে কর আদায় বাড়ানোর সুযোগ আছে। উত্তরাধিকার করের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কর আদায় বাড়লে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ বাড়বে। এর মাধ্যমে সরকারের সামাজিক বিনিয়োগ বাড়বে, যা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনকে সহজ করবে। আবার এভাবে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠাও সহজ হবে।
গবেষণা সংস্থা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর অলস সম্পদের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, গুলশানের মত জায়গায় ৩০০ কোটি টাকার জমিতে এক তলা বাড়ি করে থাকার দরকার নেই। এ কথা বলার সুযোগ নেই, জমি থেকে আয় নেই, নগদ অর্থ নেই। কর দেওয়ার টাকা না থাকলে ডেভেলপারের কাছে জমি দিয়ে ধনী হওয়া যেতে পারে। এতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, সম্পদের অবৈধ ব্যবহার কমাতেও এর ওপর কর বাড়ানো দরকার। এর ফলে সামাজিক সাম্যের সঙ্গে শান্তিও বাড়বে। বাজারদরের তুলনায় মৌজা দর কম হওয়ার কারণে সরকার যেমন রাজস্ব আয় কম পাচ্ছে, তেমনি জমির বিক্রেতারও বড় অঙ্কের অপ্রদর্শিত আয় তৈরি হচ্ছে। এ সমস্যা দূর করতে মৌজা দর বাজারভিত্তিক হতে হবে। অবশ্য সম্পদ কর এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে মানুষ ভয় না পায়।সংলাপে আরও বক্তব্য দেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি, বাংলাদেশ ইইউ ডেলিগেশনের হেড অব কো-অপারেরশন মাওরিজিও সিয়ান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট স্নেহাশীষ বড়ুয়া প্রমুখ।