মেয়েদের বহুল ব্যবহৃত প্রসাধনী লিপস্টিক। পণ্যটি দেশে উৎপাদন করলে (একপিস ৩.৭ গ্রাম) স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক ও কর দিতে হয় প্রায় ২০৫ টাকা। কিন্তু একই পণ্য আমদানি করলে শুল্ককর লাগে মাত্র ৪৩ টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে প্রসাধনী উৎপাদন করতে প্রায় পাঁচগুণ বেশি খরচ করতে হয়, যা এ শিল্প বিকাশের প্রধান অন্তরায়।শুল্ককরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একপিস লিপস্টিকে সম্পূরক শুল্ক ২ টাকা ৯০ পয়সা, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১ টাকা ৪০ পয়সা ও সরবরাহ পর্যায়ে পরিশোধিত ভ্যাট ৩৮ টাকা ৬০ পয়সা দিতে হয়। অর্থাৎ, মোট করভার ৪২ টাকা ৯০ পয়সা।একই ধরনের লিপস্টিক দেশে উৎপাদন করলে সরবরাহ পর্যায়ে সম্পূরক শুল্কই দিতে হয় ৭৭ টাকা ১৯ পয়সা। একই সঙ্গে সরবরাহ পর্যায়ে পরিশোধিত কর ১২৭ টাকা ৩৭ পয়সা। উৎপাদনের ক্ষেত্রে মোট করভার দাঁড়ায় ২০৪ টাকা ৫৬ পয়সা।শুধু লিপস্টিক নয়, কালার কসমেটিকসের মধ্যে ফাউন্ডেশন, কনসিলার, ফেসপাউডার, লিপস্টিক, মাসকারা, আইলাইনার, ব্লাশসহ অধিকাংশ পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে শুল্ককরের এমন বড় বৈষম্য রয়েছে।স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন, সম্ভাবনাময় দেশীয় প্রসাধনী বা কসমেটিকস শিল্প খাতের বড় বাধা এ সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট। এতে হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় বিনিয়োগ।চলতি বছরের শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন এ শিল্পের বিকাশে সহায়ক নীতি প্রণয়নে জোরালো সুপারিশ করলেও তা উপেক্ষিত ছিল সবশেষ বাজেটে (২০২৪-২৫)। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশকে গুরুত্ব না দেওয়া স্থানীয় শিল্পের জন্য নেতিবাচক বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরাও।
যা বলছে এনবিআর
শুল্ক-কর প্রসঙ্গে কথা বলতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও সম্ভব হয়নি। পরে আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্তকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, প্রসাধনী আমদানি ও স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনের মধ্যে একটি ফারাক রয়েছে। এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের পক্ষ থেকেও আমাদের জানানো হয়েছিল। সবশেষ বাজেটে সেটার প্রতিফলন ছিল না। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনো পর্যালোচনা চলছে।তিনি বলেন, প্রসাধনী আমদানির আড়ালে ব্যাপক হারে অর্থ পাচারের সংযোগ থাকায় বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে অবস্থান নিয়েছে এনবিআর। এ খাতের ব্যবসায়ীরা ন্যূনতম করের জালে পণ্যের দাম অনেক কমিয়ে দেখায়। বাকি টাকা বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আগামী বাজেটের আগে কীভাবে বিষয়টি সমাধান করা যায় সে চেষ্টা চলছে। সেক্ষেত্রে দেশি উৎপাদকরা সুবিধা পাবে।
এ খাতে দেশি বিনিয়োগে শুল্ককরের জটিলতা
শুল্ককরের জটিলতায় দেশে কালার কসমেটিকস উৎপাদন খাতে বড় বিনিয়োগ আসছে না। এতে বাংলাদেশে কসমেটিকস খাত এখনো আমদানি ও লাগেজনির্ভর। পাশাপাশি নকল পণ্যে বাজার সয়লাব। দেদারসে দেশে ঢুকছে মানহীন পণ্য। এতে ক্রেতারা প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টির জন্য ভেজাল ও মানহীন কসমেটিকস পণ্য দায়ী হলেও তার যথাযথ তদারকি না থাকায় ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।এসব বিষয়ে কসমেটিকস খাতের উদ্যোক্তা ও এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলী জামান জাগো নিউজকে বলেন, শুল্ককর জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে দেশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদিত না হওয়ায় বিদেশি পণ্যের ডাম্পিং স্টেশন হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। দেশে যখন মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে অনেক কোম্পানি এগিয়ে আসছে, তখন অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে। আমদানি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে এত বড় বৈষম্য কোনো খাতে নেই।বিদেশি মানহীন পণ্য আমদানির ফলে বিপুল অঙ্কের টাকা চলে গেছে বিদেশে। ফলে সরকারের উচিত নিম্নমানের পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেশি উৎপাদকদের নীতি সহায়তা দেওয়া। তাতে অর্থপাচার কমে রাজস্ব বাড়বে।- অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী উদ্যোক্তারা আরও বলছেন, আমদানিনির্ভর এ শিল্পের পণ্য দেশে উৎপাদিত হলে আমদানি-বিকল্প পণ্য হিসেবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্যের তালিকায় রয়েছে ওষ্ঠাধার প্রসাধন, চক্ষু প্রসাধন, হাত, নখ বা পায়ের প্রসাধন, পাউডার, সুগন্ধিযুক্ত বাথ সল্ট এবং গোসল সামগ্রীসহ সংশ্লিষ্ট প্রসাধনসামগ্রী।