বঙ্গবন্ধুর নামে থাকা প্রতিষ্ঠানে অনুদানে করছাড় বাতিল করছে সরকারখেজুর আমদানিতে শুল্ক-কর কমলদেশে উৎপাদিত প্রসাধনীতে করের বোঝা, আমদানিতে ছাড়ভোজ্যতেল আমদানিতে কমলো ভ্যাটখেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশ
No icon

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় সরকারিভাবে কোনো ঋণ পায়নি বাংলাদেশ

তিন অর্থবছর ধরে ভারতের কাছ থেকে পাওয়া বাংলাদেশের অনুদানের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এই সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় সরকারিভাবে কোনো ঋণ পায়নি বাংলাদেশ, যদিও দেশটির দেওয়া লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ঋণ পাওয়া অব্যাহত রয়েছে।

ভারতে গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে। সেই বাজেট নথিতে উল্লেখ করা ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রকৃত হিসাব অনুসারে, ভারতের কাছ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম অনুদান পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর পরের স্থানেই আছে বাংলাদেশ, অর্থাৎ তালিকায় নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়।

ভারতের সরকারি নথির তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ভারত অনুদান দিয়েছে ১৩৩ দশমিক ৮৮ কোটি রুপি। পরের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত আনুমানিক হিসাব অনুসারে বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ১৩০ কোটি রুপি, অর্থাৎ আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় চার কোটি রুপি কম। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন দেশের জন্য ঋণ ও অনুদানের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশকে প্রদেয় অনুদানের পরিমাণ আরও কমে ১২০ কোটি রুপিতে দাঁড়িয়েছে। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রকৃত হিসাব অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অনুদান ও ঋণ পেয়েছে ভুটান। সেই অর্থবছরে প্রতিবেশী দেশটি ভারতের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছে ১ হাজার ৭৩৬ কোটি রুপি এবং ঋণ পেয়েছে ৭০৪ কোটি রুপি। অন্যান্য প্রাপ্তিসহ তারা ভারতের কাছ থেকে সব মিলিয়ে পেয়েছে ২ হাজার ৪৬৭ কোটি রুপি।

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের কাছ থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অনুদান পেয়েছে মিয়ানমার, ৪৫৪ দশমিক ৬২ কোটি রুপি। এ ছাড়া নেপাল অনুদান পেয়েছে ৪৩৪ দশমিক ২৭ কোটি রুপি, আফগানিস্তান ২৭৯ দশমিক ৩৭ কোটি রুপি এবং মালদ্বীপ পেয়েছে ১৮৩ দশমিক ১৬ কোটি রুপি।

দক্ষিণ এশিয়া ছাড়া ভারত আফ্রিকা, ইউরেশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলের দেশকে ঋণ ও অনুদান দিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত মোট ঋণ ও অনুদান দিয়েছে ৭ হাজার ৯০ কোটি রুপি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত আনুমানিক হিসাব অনুসারে, ভারত মোট ঋণ ও অনুদান দিয়েছে ৮ হাজার ৯৯০ কোটি রুপি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অন্তর্বর্তী বাজেট অনুসারে, ভারত মোট ঋণ ও অনুদান দেবে ৯ হাজার ৬২২ কোটি রুপি। 

প্রতিবছরের ১ ফেব্রুয়ারি ভারতের অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট পেশ করেন। তবে লোকসভা ভোটের বছরে নির্বাচনের আগে সংসদে ভোট-অন-অ্যাকাউন্ট বা অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ হয়। লক্ষ্য হলো, নতুন আর্থিক বছরে ভোটের পরে নতুন সরকার গঠন করে পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করা পর্যন্ত সরকারি কাজ নির্বিঘ্ন রাখা। এবার ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ৪৭ লাখ কোটি রুপির বেশি বরাদ্দ প্রস্তাব করে বাজেট পেশ করেন। ভারতের অনুদানের চিত্র বাজেটের এই নথি থেকেই পাওয়া গেছে।

অনুদান পাওয়ার সঙ্গে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। বাংলাদেশের এখন যে অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে সব দেশই এখন অনুদান কমিয়ে দিয়ে অনমনীয় শর্তে ঋণ দিচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে তার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের কাছ থেকে তেমন একটা অনুদান পাচ্ছে না। এর অর্থ এই নয়, তারা আমাদের সমর্থন করছে না। বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। এই কাতারে উত্তরণের পর থেকে অনুদান তো কমছেই, সেই সঙ্গে স্বল্প সুদের ঋণও কমে যাচ্ছে। বাড়ছে উচ্চ সুদের ঋণ।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, সেই বাস্তবতায় ভারত এখন লাইন অব ক্রেডিট দিতে বেশি আগ্রহী। এখন ভারতের তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট শুরু হয়েছে। তবে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, পদ্মা সেতুর জন্য ভারত প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের ২০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে দিয়েছিল। উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ উন্নত করার লক্ষ্যে তারা তখন এটা করেছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।

প্রায় দুই দশক আগে ভারতের এক্সিম ব্যাংক প্রথম লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) ধারণা নিয়ে বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেওয়া শুরু করে। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু। এক্সিম ব্যাংক ভারতের রপ্তানি, বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশকে ঋণসহায়তা দিতে থাকে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ১০০ কোটি ডলারের লাইন অব ক্রেডিট পায়। তিনটি এলওসির মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার চুক্তি করেছে। কিন্তু এই তিন এলওসির আওতায় এখন পর্যন্ত খুব বেশি অর্থ ছাড় করা হয়নি।

২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম এলওসি সই হয় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে। এরপর ২০১৫ সালে দ্বিতীয় এলওসির আওতায় ২০০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়। দুই বছর পর ২০১৭ সালে ৪৫০ কোটি ডলারের তৃতীয় এলওসি হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৬৫ কোটি ডলার ছাড় করেছে এক্সিম ব্যাংক।

এলওসি থেকে ঋণ ছাড়ের গতি কম হওয়ায় নতুন করে ভারতের কাছ থেকে আর গুচ্ছ ঋণ বা এলওসি না নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে এখন থেকে প্রকল্প ধরে সরকারি সংস্থাকে আলাদাভাবে ঋণ দিতে চায় এক্সিম ব্যাংক। এ ছাড়া চুক্তির শর্ত শিথিল করা নিয়েও এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যেমন এখন শুধু ভারতীয় ঠিকাদারেরাই এলওসি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিতে পারেন। ফলে তাঁদের নির্ধারিত দরেই কার্যাদেশ দিতে হয়। 

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশীদারত্বের বা জয়েন্ট ভেঞ্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও যাতে দরপত্রে অংশ নিতে পারে, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। এলওসির কোনো প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ (কিছু ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ৬৫ শতাংশ) পণ্য বা সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে, বর্তমানে এমন শর্ত আছে। এই শর্ত শিথিল করার জন্যও দর-কষাকষি চলছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অনুদান কম পাওয়ার পেছনে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ভূরাজনীতির সঙ্গে ভূ-অর্থনীতির সম্পর্ক আছে। তবে আমাদের অর্থনীতির যে আকার, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টিকে অনুদানের সঙ্গে সম্পর্কিত করা ঠিক হবে না।