বঙ্গবন্ধুর নামে থাকা প্রতিষ্ঠানে অনুদানে করছাড় বাতিল করছে সরকারখেজুর আমদানিতে শুল্ক-কর কমলদেশে উৎপাদিত প্রসাধনীতে করের বোঝা, আমদানিতে ছাড়ভোজ্যতেল আমদানিতে কমলো ভ্যাটখেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশ
No icon

পুরস্কার-প্রণোদনা আছে অপরাধে নেই শাস্তি

নতুন ভ্যাট আইন করদাতাবান্ধব করে তোলার লক্ষ্যে গঠিত কমিটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে ২০১২ সালে প্রণীত আইনটির কয়েকটি ধারায় আংশিক আইনগত, ভাষাগত ও বানান সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। মৌলিক পরিবর্তনের প্রস্তাব আসেনি। ভ্যাট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কার ও আর্থিক প্রণোদনা নিশ্চিত করতে সুপারিশ করেছে কমিটি। কিন্তু দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির সুপারিশ না করে উল্টো দায়মুক্তি দেয়ার জন্য আইনে নতুন ধারা সংযোজনের সুপারিশ করেছে। অবশ্য আইনে টার্নওভার ট্যাক্স ৮০ লাখ টাকা নির্ধারণ ও করে একক হার না রাখার পক্ষে কমিটি মত দিয়েছে। নতুন ভ্যাট আইনকে করদাতাবান্ধব করে গড়ে তুলতে গত বছরের ১১ নভেম্বর ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করে এনবিআর। এর নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার আবদুল মান্নান শিকদার। এ কমিটিতে ৪ জন কমিশনার ও ২ অতিরিক্ত কমিশনারকে রাখা হয়। এ কমিটির দেয়া সুপারিশের ভিত্তিতে গত সপ্তাহে এনবিআর চেয়ারম্যান এফবিসিসিআই নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সূত্র জানায়, আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে সরকার বদ্ধপরিকর। এজন্য কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। একইসঙ্গে আইনের কোন কোন বিষয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তি আছে তা জানাতে বলা হয়েছে।

কমিটি আইনে নতুন ধারা ১৩৩খ সংযোজনের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের পুরস্কার দেয়ার সুপারিশ করেছে। এ ধারায় কর ফাঁকির তথ্য দেয়ার জন্য সোর্সকে এবং তা উদঘাটনের জন্য কর্মকর্তাদের শর্তসাপেক্ষে পুরস্কার দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। প্রস্তাবের যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে, কর আদায়ে বিশেষ কার্যক্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার প্রদান করা হলে তা কর্মকর্তাদের কর আদায় প্রক্রিয়ায় অধিক হারে ব্যাপৃত করবে। তাই নতুন এ ধারাটি সংযোজন করা প্রয়োজন।

এরপরেই ১৩৩গ ধারা সংযোজনের মাধ্যমে ভ্যাট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কারের পাশাপাশি আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় বেশি হলে তার একটি অংশ এনবিআর এবং ভ্যাট কমিশনারেটে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রণোদনা হিসেবে বেতন স্কেল অনুপাতে প্রদান করতে হবে।

এর যৌক্তিকতায় বলা হয়েছে, এ নতুন ধারার মাধ্যমে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা আদায়ে কর্মকর্তাদের অধিকতর উৎসাহিত করা যাবে। ফলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। ১৩৩ঘ ধারা সংযোজনের মাধ্যমে কর ফেরত এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কার ও আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার জন্য তহবিল গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

আইনে নতুন ধারা সংযোজনের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা রাখার সুপারিশ করা হলেও ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা অসাধু কর্মকর্তাদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে আইনগত সুপারিশ করা হয়নি। উল্টো দায়মুক্তি দিতে নতুন ধারা সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে। সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ শিরোনামে ১২৯ক ধারা সংযোজনের সুপারিশ করেছে কমিটি।

এতে বলা হয়েছে, এ আইন বা কোনো বিধির অধীনে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তার জন্য সরকার বা তার কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যধারা দায়ের বা রুজু করা যাইবে না।

কমিটির সুপারিশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আইনে নতুন ৬টি ধারা সংযোজন, ৩টি ধারা ও ১টি উপধারা বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে। বাকি ধারাগুলোতে আংশিক বা শব্দগত পরিবর্তন আনা হয়েছে।

এক্ষেত্রেও ভ্যাট কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। যেমন ১২৬ ধারায় সরকার কর্তৃক কর অব্যাহতি-এর উপধারা-২ এ বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ঋণ চুক্তির অধীন কোনো আমদানি বা সরবরাহের ওপর প্রযোজ্য করের আংশিক বা সমুদয় অব্যাহতি দেয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত থাকলে এবং চুক্তিটি বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে করা হলে, সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা আরোপযোগ্য করের আংশিক বা সমুদয় অব্যাহতি দিতে পারবে। এখানে চুক্তিটি বোর্ডের সাথে পরামর্শ করে করা হলে যুক্ত করা হয়েছে।

ফলে অব্যাহতি সুবিধা পেতে বাধ্যতামূলকভাবে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। এছাড়া ভ্যাট কর্মকর্তাদের সুশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত করতে নির্দিষ্ট পোশাক ও ভাতা নির্ধারণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

অবশ্য ব্যবসায়ীদের দাবির কিছু প্রতিফলনও সুপারিশে এসেছে। যেমন টার্নওভার ট্যাক্সের সীমা ৮০ লাখ টাকা নির্ধারণ, একক হারের পরিবর্তে পণ্য ও সেবার জন্য তফসিলভিত্তিক ভ্যাট হার নির্ধারণ, সহযোগীর সংজ্ঞা থেকে ব্যক্তির আত্মীয় ও তার অধীনে চাকরিরতদের বাদ দেয়া ও কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের সুপারিশ করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইনে কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করার বিধান রাখায় আপত্তি নেই, তবে দায়মুক্তি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ ধারার সুযোগ নিয়ে অসাধু কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতে পারেন এবং সে ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নালিশ জানানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। আইনেই যেভাবে পুরস্কারের কথা বলা আছে, তেমনি শাস্তির কথাও বলা থাকা উচিত।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মঙ্গলবার বলেন, নতুন আইনে এসব ধারা যুক্ত করা হলে তা আরেকটি কালাকানুন হবে। ভালো কাজ করলে পুরস্কৃত করা হবে, কিন্তু অন্যায় করলে সরল বিশ্বাস বিবেচনায় দায় মুক্তি দেয়া হবে-সেটা অযৌক্তিক। অবশ্যই কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। খারাপ কাজে শাস্তির বিধান রাখতে হবে।

কারণ দেশের সংবিধান অনুযায়ী কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না। তিনি আরও বলেন, এনবিআরে অনেক বুদ্ধিমান অফিসার আছেন। আশা করছি তারা এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন। টার্নওভার ট্যাক্স সম্পর্কে তিনি বলেন, এফবিসিসিআই সভাপতি বর্তমান সময়ের বিবেচনার টার্নওভারের সীমা বাড়াতে হবে।

ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের মহাসচিব আবু মোতালেব বলেন, একজন ভ্যাট কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার কারণে একটি ব্যবসা ধ্বংস ও একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে অভিযোগ জানানো যাবে না- নতুন ভ্যাট আইনে এ ধরনের ধারা রাখা হলে তা কালো আইন হিসেবে পরিণত হবে। এ ধারার সুযোগ নিয়ে অসাধু কর্মকর্তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

আইনে কর্মকর্তার পুরস্কার-প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের অহেতুক হয়রানি করলে প্রমাণসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে- সেটিও উল্লেখ থাকতে হবে।

আবু মোতালেব আরও বলেন, ভ্যাট কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, অনেক ব্যবসায়ী প্যাকেজ ভ্যাটও দিতে চায় না। কারা প্যাকেজ ভ্যাট দেয় না, সেটিও তারা জানেন। তাহলে এদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয় না কেন?

প্রকৃতপক্ষে ভ্যাটের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এ ধরনের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধাভোগী। তাই ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু রিপোর্ট করেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন।

টার্নওভার ট্যাক্স কমানোর আহ্বান জানিয়ে ঐক্য ফোরাম মহাসচিব বলেন, পুরান ঢাকার অধিকাংশই পাইকারি বিক্রেতা। এসব দোকানে প্রতিদিন লাখ টাকার বেশি বেচাবিক্রি হয়। কিন্তু লাভ সীমিত। ১-২ শতাংশ লাভ করে ৩ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দেয়া সম্ভব নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এবার আইনটিকে ব্যবসাবান্ধব করেই বাস্তবায়ন করা হবে। এনবিআর গঠিত কমিটি যে সুপারিশ করেছে, সেটিকে ভিত্তি ধরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আইনে আর কী কী সংশোধন আনা যায়, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এখন ব্যবসায়ীদের আইনগত মতবিরোধ থাকার কথা নয়। তিনি আরও বলেন, হ্রাসকৃত হারে কোন কোন পণ্য ও সেবা থাকবে সে তফসিল নিয়ে আলোচনা হতে পারে।