মোট রাজস্ব আয়ের অর্ধেক আয়কর খাত থেকে অর্জনের ভিত্তি ধরে প্রণয়ন করা হচ্ছে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব পরিকল্পনা। এ জন্য কর নেটের আওতা বাড়ানো হবে। চলতি বছরের মধ্যেই জিডিপির কর অনুপাত ১৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে। এমন লক্ষ্য স্থির করে আগামী অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। কাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটি উপস্থাপন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এবার নতুন ভ্যাট আইন ঘিরেই বাজেট ঘোষণা হবে। ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হচ্ছে। কাজেই সব প্রজ্ঞাপন, আদেশ হবে এর আওতায়। এ আইনের মূল ভিত্তিই হচ্ছে ভ্যাটের জাল বাড়ানো। ভ্যাট হার, ট্যারিফ মূল্য, সম্পূরক শুল্ক, সেবা খাতে ভ্যাটের হার নির্ধারণসহ নানা ইস্যুতে ব্যবসায়ীদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে হার না বাড়িয়ে ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। এখন বাজেট ঘোষণার মধ্য দিয়ে এর প্রতিফলন হবে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বাড়ানো হবে। তবে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে নয়। কর ও ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে এটি করা হবে। যারা কর দিচ্ছেন না, অথচ উপযুক্ত তাদের কর নেটের আওতায় আনা হবে। আমি এবার প্রথমে সংসদে দাঁড়িয়ে বলব, যারা বেশি কর দিয়েছেন, তারা এখন কম দেবেন, আর যার এতদিন দেননি তারা কর দেবেন।
সূত্র মতে, আগামী বাজেটের আকার হবে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এই ব্যয় মেটাতে রাজস্ব খাত থেকে মোট আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী বছরে ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা বেশি আয় করতে হবে।
সূত্র আরও জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ১০০ কোটি টাকা, এটি জিডিপির ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে এনবিআর কর রাজস্ব পরিমাণ হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। এনবিআরবহির্ভূত কর রাজস্ব পরিমাণ হচ্ছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরে কর রাজস্বের পরিমাণ হচ্ছে ৩ লাখ ৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর কর রাজস্ব পরিমাণ ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং এনবিআরবহির্ভূত কর রাজস্ব পরিমাণ হচ্ছে ৭ হাজার ২২০ কোটি টাকা। চলতি বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে ৩৪ হাজার ১৭০ কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের শুরুতে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২ বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক বিধিমালাও কার্যকর হবে। পাশাপাশি শুল্ক আইন প্রণয়ন হচ্ছে। এটিও বাস্তবায়ন করা হবে। এসব কারণে সরকার আশা করছে, আগামীতে রাজস্ব আয়ের গতি আরও বাড়বে। এছাড়া সার্বিকভাবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা শক্তিশালীর পাশাপাশি রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কর রাজস্বও বাড়বে।
রাজস্ব আদায় করতে কর ও ভ্যাটের চাপ সাধারণ মানুষের ওপর দেয়া হবে না। তবে এবারের বাজেটে কর হার না বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানোর বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি করা হবে আইনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে। অধিকসংখ্যক মানুষকে আয়করের আওতায় আনা, ভ্যাটের আওতা বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ভ্যাট আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হবে না। কারণ এটি করলে অনেকে করের আওতার বাইরে চলে যাবেন। তবে করসীমা বাড়ানো বা অপরিবর্তিত থাকবে কিনা- সেই সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী। তবে কর আদায়ের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্রত্যেক উপজেলায় অফিস স্থাপন করা হবে। বিত্তবানদের করের আওতায় আনা হবে। বাজেটে সেদিক নির্দেশনা থাকবে।
অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, আসন্ন বাজেটে সব ধরনের কর্পোরেট কর হার কমানো হবে। অন্যদিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির টার্নওভার ট্যাক্স আদায়ে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে। মূলত ফাঁকি বন্ধের মাধ্যমে ভ্যাট আদায়ের উদ্যোগ থাকবে বাজেটে। দেশীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশন, মোটরসাইকেল শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালের মধ্যে কর জিডিপি অনুপাত ১৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করা হবে। কর অব্যাহতির যৌক্তিকরণের পাশাপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত অগ্রাধিকার খাতকেও প্রণোদনা দেয়া হবে। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে বাংলায় যুগোপযোগী আয়কর আইন প্রণয়ন করা হবে।
এছাড়া উৎসে আয়কর কর্তন ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা হবে। পাশাপাশি প্রচলন করা হবে ইলেক্ট্রনিক উৎসে কর। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি আধুনিক ও প্রযুক্তিমুখী কর তথ্য ইউনিট গঠন করা হবে। এর মাধ্যমে কর ফাঁকি উদঘাটন ও করদাতা শনাক্ত করা হবে।
এদিকে সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটের খসড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় বাজেটের বিভিন্ন দিক বর্ণনা করা হয়। আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার আগামী অর্থবছরের রাজস্ব পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা নিয়েই চূড়ান্ত করা হবে নতুন অর্থবছরের বাজেট।