দেশের অর্থনীতির অন্যতম সমস্যা বিদেশে অর্থ পাচার। ২০১৫ সালে দেশের মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬ শতাংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। এই পাচার বন্ধ হলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। জাতিসংঘের বিনিয়োগ বাণিজ্য সংস্থা আঙ্কটাডের রিপোর্টে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষে বাংলাদেশে এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। রাজধানীর ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। বাংলাদেশ-বৈদেশিক সম্পর্ক এবং স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসার পর সম্ভাব্য ঝুঁকি ও করণীয় বিষয়ে বক্তব্য রাখেন তারা।
বক্তারা বলেন, ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে চলে যাচ্ছে। এই দুই উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তায় তিনটি প্রভাব পড়বে।
প্রথমত, সাশ্রয়ী হারে আগে যেভাবে অর্থ পাওয়া যেত সেটি বন্ধ হবে, রফতানিতে বিভিন্ন দেশের বাজার সুবিধা কমবে এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা কমে যাবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিকল্প কী করণীয় তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের মোট রাজস্ব আয় ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এর ৩৬ শতাংশের মানে হল ওই সময়ে দেশ থেকে ৬৫৪ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। যা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু করা যায়।
আঙ্কটাডের রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে কম্বোডিয়া থেকে। দেশটির পাচারের পরিমাণ মোট করের ১২০ শতাংশের বেশি।
আর সবচেয়ে কম পাচার হয়েছে, পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসে। যা ওই দেশের রাজস্বের ১ শতাংশের কম। সাম্প্রতিক সময়ে পাচারের অর্থ এই রিপোর্টে যুক্ত হয়নি। এছাড়া অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় কর আহরণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ওই রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের উন্নয়ন মূলত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং কৃষিতে সীমাবদ্ধ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সব সময় তিন ধরনের ঘাটতির মধ্যে থাকে। প্রথমত, সঞ্চয় দিয়ে বিনিয়োগে পূর্ণভাবে অর্থায়ন করা যায় না। ফলে বিনিয়োগ সঞ্চয়ের ভেতরে ঘাটতি আছে।
দ্বিতীয়ত, সরকার যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে, তার পুরোটাই করের মাধ্যমে আসে না। এক্ষেত্রে আর্থিক ঘাটতি থাকে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ রফতানি, রেমিটেন্স এবং বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে, তা দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো যায় না। আর এই তিন ঘাটতি পূরণের জন্য ঋণ নিতে হয়। এর মধ্যে কিছুটা দেশের মধ্য থেকে আবার কিছু বৈদেশিক ঋণ। এ কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিদেশি সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে থাকবে। একটি বিকাশমান অর্থনীতির এটাই চরিত্র।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই কাঠামোগত অর্থনীতির ভেতরে দুটি বিষয় যোগ হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে- ২০১৫ সালে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এর ফলে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের ঋণ দিত, তা মনে করে আমরা বেশি সুদে ঋণ নেয়ার সামর্থ্য অর্জন করেছি। এ কারণে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ঋণের সুদের হার আগের চেয়ে বাড়িয়েছে। আর অন্য আরেকটি বিষয় হচ্ছে- ২০২৪ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বের হয়ে যাব। এই বিবিধ উত্তরণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো বলেন, এটি লক্ষণীয় বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যতম। এক দশকে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহার করেছে। আর এক্ষেত্রে যে দায়দেনা সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনও আয়ত্তের মধ্যে আছে। ফলে বাংলাদেশ কোনোদিন বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমান্বয়ে মিশ্র অর্থনীতির দিকে যাচ্ছি আমরা। একদিকে বৈদেশিক অনুদান নেয়া হচ্ছে, অপরদিকে ঋণও বাড়ছে। কিন্তু অনুদানের চেয়ে ঋণ অত্যন্ত বেশি। ফলে দায়দেনা ও দেনা পরিশোধের হার দুটিই বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই ঋণ ব্যবহারের গুরুত্ব কতটুকু রয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৩৭ শতাংশ বৈদেশিক অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল। আবার এই ৩৭ শতাংশের ৪৭ শতাংশ সামাজিক খাতে এবং ৪৪ শতাংশ আর্থিক অবকাঠামো খাতে ব্যবহার হচ্ছে। এর মানে হল উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য অংশই বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ফলে মধ্যম আয়ের দেশ ও স্বল্পোন্নত দেশে কাতারে চলে আসার পর তা বৈদেশিক সহায়তায় কী প্রভাব ফেলবে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তার মতে, সামগ্রিকভাবে বিদেশ থেকে যেসব ঋণ নেয়া হচ্ছে, তার ব্যবহার ও দায়দেনায় কী প্রভাব ফেলবে, তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। কারণ পৃথিবীর বহু দেশ আছে, এ রকম পরিস্থিতিতে তার দায়দেনার হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আরেকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির কাঠামো শক্তিশালী করতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কর আহরণের বিকল্প নেই। কারণ আমাদের রাজস্ব আয় না বাড়লে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীও টাকা দেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাবে না। কারণ বিশ্বে একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলা হয়, তা হল-তোমরা যত টাকা দেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারবে, আমরা তত টাকা দেয়ার জন্য আগ্রহ দেখাব।
মধ্যম আয় এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা চলে এলে যেসব বৈদেশিক সহায়তা কমবে, তা পূরণের জন্য বিকল্প কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তা ভাবতে হবে। তিনি আরও বলেন, সামাজিক খাত ও পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে যে প্রভাব পড়বে, তা মোকাবেলায় অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের যে রফতানি আয় হয়, তা বাজার সুবিধায় নির্ভরশীল। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে এলে বিভিন্ন দেশে যে বাজার সুবিধা (জিএসপি) পাওয়া যায়, তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কী করা যায়, তা ভাবতে হবে।
পাশাপাশি স্বল্পোন্নত দেশে থাকাকালীন যে প্রযুক্তি সুবিধা পাওয়া যেত, বন্ধ হলে কী করণীয়, সেটি অবশ্যই ভাবতে হবে। ড. দেবপ্রিয় বলেন, এই সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত জরুরি। অর্থাৎ পরিষদ যদি সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা আগের মতো সহায়তা অব্যাহত রাখব। তবে কেবল সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব।