বিমানবন্দরের গোডাউন থেকে মেমোরি কার্ড গায়েবের অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে এক ব্যক্তি ৪০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেছে। এমন নজিরবিহীন ঘটনায় এনবিআরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ওই ব্যক্তির আবেদনের যৌক্তিকতা ও প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে ইতোমধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান নির্দেশ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, এনবিআরের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ঘটনায় পুরো রাজস্ব প্রশাসনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে ঢাকা কাস্টমস থেকে ফাইল তলব করা হয়েছে। বিমানবন্দরের গোডাউন থেকে মেমোরি কার্ড গায়েবে কারা জড়িত এবং মেমোরি কার্ড আটকের পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে কাস্টমসের কিছু গাফিলতি পাওয়া গেছে। তবে মেমোরি কার্ড আটকের ঘটনা আরও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। চোরাচালানের দায়ে ২০১৬ সালে এসব মেমোরি কার্ড আটক করা হয়। এরপর আদালতের নির্দেশে তা ছাড়ে কাস্টমস আদেশ জারি করে। এই পুরো প্রক্রিয়াতেই বিশদ অসঙ্গতি রয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে আলাদাভাবে দুই শাখা কাজ করেছে। গোডাউনের মালামাল গায়েবে কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখতে শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসন শাখা কাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে পণ্য আটক, নিলাম প্রক্রিয়া ও খালাসসহ সামগ্রিক বিষয় খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা শাখা।
এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চোরাচালানের দায়ে কাস্টমস মেমোরি কার্ড আটক করলেও মামলা কেন করেনি, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
পণ্য আটক ও পরবর্তী সময়ে আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি ধাপে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আবার এখন গোডাউন থেকে পণ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুল্ক গোয়েন্দা ও অন্য সংস্থার সহায়তায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।
ঘটনার সূত্রপাত : ২০১৬ সালের ১১ জুন হংকং থেকে ঘোষণা ছাড়া ২ লাখ ১০ হাজার পিস মেমোরি কার্ড নিয়ে আসেন ওই ব্যক্তি। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমস কর্মকর্তারা গ্রিন চ্যানেলে অবস্থান নেন। একপর্যায়ে যাত্রীকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি জানান, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য পণ্য ছাড়া অন্য কোনো পণ্য তার কাছে নেই।
পরে তল্লাশি করে ব্যাগে লুক্কায়িত অবস্থায় মেমোরি কার্ড পাওয়া যায়। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, যাত্রী ১০ লাখ টাকা বেশি মূল্যের পণ্য আনলে তা ঘোষণা দেয়া হলেও চোরাচালান হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে আটক চালানের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৮৩ লাখ টাকা ধার্য করা হয়। অন্যদিকে লুক্কায়িত অবস্থায় ব্যাগেজে বা নিজ দেহে পণ্য আনলেও তা চোরাচালান হিসেবে বিবেচ্য।
আটকের পর ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী, প্রধান আমদানি ও রফতানি নিয়ন্ত্রকের দফতরের (সিসিআইএন্ডই) ছাড়পত্র (আইপি/সিপি) প্রদান সাপেক্ষে শুল্ক-কর পরিশোধ করে মালামাল খালাসে কাস্টমস দুই দফা নোটিশ জারি করে। কিন্তু দুবার চেষ্টা করেও ছাড়পত্র দিতে ব্যর্থ হন।
এরপর ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি এক অঙ্গীকারনামায় ওই ব্যক্তি উল্লেখ করেন, আইপি/সিপি দাখিলে তিনি ব্যর্থ। আটক পণ্যসমূহ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তসহ আইনানুগ নিষ্পত্তি করতে আপত্তি নেই।
পরবর্তী সময়ে কোথাও এ বিষয়ে কোনো আপিল করবেন না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি তৎকালীন কাস্টমস কমিশনার (লুৎফর রহমান, বর্তমানে অবসরে আছেন) মেমোরি কার্ড রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন।
তৎকালীন কমিশনার লুৎফর রহমান মঙ্গলবার টেলিফোনে বলেন, ওই মামলার বিচারাদেশ দেয়ার সময় পণ্যের মালিকানা দাবিদার কাউকে পাইনি। তাই রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিই।
তিনি আরও বলেন, এখন পণ্যের দাবিদারের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনের মামলা হওয়া উচিত। কারণ, বিদেশে ৫ হাজার ডলারের বেশি নেয়া যায় না। তাহলে উনি কীভাবে ৮৩ লাখ টাকা পণ্য আনলেন।
জানা গেছে, কমিশনারের বাজেয়াপ্তের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে ওই ব্যক্তি আদেশে উল্লিখিত শুল্ক-কর পরিশোধ করে তার পণ্য ফেরত দিতে কাস্টমসে আবেদন করেন। কাস্টমসে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে পরে আদালতে রিট করেন।
আদালত কাস্টমসে জমা দেয়া আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন কমিশনার (প্রকাশ দেওয়ান, বর্তমানে অবসরে আছেন) ১৪ মার্চ ওই ব্যক্তিকে চিঠি দিয়ে জানান, আমদানি সনদ, ছাড়করণ সনদ বা ঋণপত্র না থাকায় আমদানি পণ্য আমদানিযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচ্য।
আর এ ক্ষেত্রে শুল্ক-কর, অর্থদণ্ড বা বিমোচন জরিমানা আরোপ সাপেক্ষে মালামাল খালাসযোগ্য নয়। এ বিষয়ে এনবিআরের শুল্কনীতির সদস্য গোলাম কিবরিয়া বলেন, কাস্টমস আইন অনুযায়ী আটক পণ্য বাজেয়াপ্তের পর নিলামে ওঠানোর বিধান রয়েছে।
আর আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য হলে তা ধ্বংস করা হবে। এ ক্ষেত্রে পণ্য বাজেয়াপ্তের পর শুল্ক পরিশোধ করে মালামাল ফেরত চাওয়ার আইনগত ভিত্তি নেই। সে নিজের ইচ্ছায় শুল্ক দিয়ে চাইতে পারে। কারণ, ব্যক্তি তো আর কাস্টমস আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।
জানা গেছে, কাস্টমসে জমা দেয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৩ মে আদালতে পুনরায় রিট করেন ওই ব্যক্তি। আদালত কাস্টমসকে শুল্ক জমা নিয়ে মালামাল ছাড়করণ এবং নিলাম স্থগিতের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কাস্টমস ‘লিভ টু আপিল’ দায়ের করে।
সুপ্রিমকোর্টে প্রধান বিচারপতির ফুল বেঞ্চে শুনানির পর বিষয়টি হাইকোর্ট ডিভিশনে পূর্ণাঙ্গ শুনানিপূর্বক দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এরপর আদালত সিসিআইএন্ডইকে আইপি/সিপি ইস্যু এবং সে অনুযায়ী কাস্টমসকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১ মার্চ কাস্টমস কমিশনার ১০ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানা ও অর্থদণ্ড আরোপ করে পণ্য ছাড়করণের নির্দেশ দেন। জরিমানা পরিশোধ করে গোডাউনে মালামাল আনতে গিয়ে লাগেজ কাটাছেঁড়া দেখতে পেয়ে পরবর্তী সময়ে এনবিআরের কাছে ক্ষতিপূরণ আবেদন করেন।
কাস্টমসের অনিয়ম-গাফিলতি : প্রথাগতভাবে চোরাচালানের ঘটনা প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গেই কাস্টমস সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করে। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। উল্টো আটক পণ্য ব্যাগেজ রুল সুবিধায় খালাসের সুযোগ রাখা হয়। অথচ ব্যাগেজ রুলে ব্যাগেজের সংজ্ঞায় বলা আছে, বিদেশফেরত যাত্রীর আনা যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয় (কাপড়চোপড়), গৃহস্থালি বা অন্য ব্যক্তিগত সামগ্রী। যার প্রতিটি আইটেমের ওজন ১৫ কেজির বেশি নয়। এ ক্ষেত্রে ২ লাখ ১০ হাজার পিস মেমোরি কার্ড কীভাবে ব্যক্তিগত ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া আটকের সময় ওই যাত্রীর পাসপোর্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাও হয়নি।
আরেকটি অনিময় হচ্ছে, আটকের সময় পণ্য কেনার সপক্ষে যে ইনভয়েস দেয়া হয়েছে তা আটক প্রতিবেদন বা পরে মূল আদেশে উল্লেখ করা হয়নি। ইনভয়েসে স্পষ্ট পণ্যের বিবরণ, দাম ও সংখ্যা উল্লেখ ছিল।
ইনভয়েসে বলা ছিল, মেমোরি কার্ড (স্টক লট)। অর্থাৎ মেমোরি কার্ড স্টক লট হিসেবে আনা হয়েছে। আমদানি নীতি অনুযায়ী, স্টক লট পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ। অর্থাৎ সুকৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে ওই ব্যক্তিকে সুবিধা দেয়া হয়েছে।