পাকিস্তানের নয় ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে উৎসে কর পরিশোধ না করেই টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ১৬০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানি মালিকানাধীন হাবিব ব্যাংকের যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি হাবিব ব্যাংকের ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে ক্যাপিটাল গেইনের (মূলধন বৃদ্ধি) ক্ষেত্রে আয়কর অধ্যাদেশের ৫৬(১) ধারা অনুযায়ী ১৫ শতাংশ উৎসে কর কার্যকর রয়েছে। অর্থ স্থানান্তরের আগে এই কর আদায় হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। কিন্তু ব্যাংক সেটি নিশ্চিত না করেই অর্থ স্থানান্তর করেছে। তাই ফাঁকি দেয়া কর ব্যাংককেই পরিশোধ করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কর ফাঁকির ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হাবিব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে হাবিব ব্যাংক ওইসব অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আইনজীবীদের মতামত নিয়ে বলেছে, ওই করের অর্থ আদায়ের দায় তাদের নয়, সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস বা স্টক এক্সচেঞ্জের। তারা শেয়ার বিক্রির টাকা থেকে করের টাকা আদায় করেনি। তারপরও হাবিব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের ১ জুলাই জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৫ শতাংশ হারে ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স পরিশোধ করেছে। সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান কর কর্তনের প্রামাণিক দলিলাদি গ্রহণ সাপেক্ষে ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে, তদন্তের সময় হাবিব ব্যাংক কর পরিশোধ এবং এর সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরদির্শকদের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মতামত চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্যের ওপর হাবিব ব্যাংকের আলোচ্য ঘটনার বিষয়ে পরিচালিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়কর অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে হাবিব ব্যাংক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ৯ ব্যক্তি ও ১টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১০টি বিদেশিদের নন রেসিডেন্ট ইনভেস্টরস টাকা অ্যাকাউন্টের (নিটা) গ্রাহকদের ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্যাপিটাল গেইন বা মূলধন বৃদ্ধি ও মুনাফা বাবদ ১১১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং বিলম্ব ফি বাবদ ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকাসহ মোট ১৫৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কর ফাঁকির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাবিব ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান রফিকুল ইসলাম রোববার বলেন, ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগ থেকে আপনার সঙ্গে যোগযোগ করা হবে। একই দিন ব্যাংকটির হেড অব কান্ট্রি অপারেশনস (অ্যাক্টিং) আফতাবউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি অফিস করছি না। এ বিষয়ে তাই কিছুই বলতে পারছি না।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে হলে যে কোনো ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের নিবন্ধন আছে- এমন শাখায় বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব খুলে সেখানে বৈদেশিক মুদ্রা জমা করতে হয়। এ হিসাবের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি নন রেসিডেন্ট ইনভেস্টরস টাকা অ্যাকাউন্ট (নিটা) হিসাব খুলতে হয়।
বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব থেকে নিটা হিসাবে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্রোকারেজ হাউসের হিসাবে টাকা স্থানান্তর করে শেয়ার কেনাবেচা করতে হয়। আবার শেয়ার বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যায়, তা ব্রোকারেজ হাউস থেকে নিটা হিসাবে আনতে হয়। পরে সেগুলো বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে যায়। এরপর তা বিদেশে নেয়া যাবে।
নিয়ম অনুযায়ী অনিবাসী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির টাকা নিটা হিসাবে স্থানান্তরের আগে গ্রাহক এর বিপরীতে যথাযথভাবে কর পরিশোধ করেছে কি না বা কোনো প্রকার কর বকেয়া রয়েছে কি না, তা ব্যাংককে নিশ্চিত হতে হবে। এরপর টাকা নিটা হিসাবে স্থানান্তর করা যাবে।
তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাবিব ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়, প্রযোজ্য কর কর্তনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউস বা স্টক এক্সচেঞ্জের। অপরদিকে ব্যাংকের কাজ হল ব্রোকারেজ হাউস থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিটা হিসাবে প্রেরণের আগে কর বকেয়া আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া।
অনিবাসী গ্রাহকরা স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত কোম্পানির প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগ করে এবং শেয়ার বিক্রির সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০১০ সালের ১ জুলাই জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স পরিশোধ করে। সংশ্লিষ্ট স্টক এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান কর কর্তনের প্রামাণিক দলিলাদি গ্রহণ সাপেক্ষে ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের সময় প্রতীয়মান হয়েছে, ব্যাংকটি কর কর্তনের বিষয়ে নিশ্চিত হতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ব্যাংক শেয়ার বিক্রির সময় কর প্রদানের বিষয়ে কোনো প্রমাণপত্র গ্রহণ না করেই টাকা নিটা হিসাবে স্থানান্তর করেছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অজ্ঞতা বা যোগসাজশ বা গাফিলতি রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কর ফাঁকির টাকা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হলে ব্যাংকটি তা কার্যকর না করে অধিকতর ব্যাখ্যার জন্য তাদের আইনজীবী প্যানেলের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করে। আইনজীবীর ৩টি প্যানেল ভিন্ন ভিন্ন মত দেয়। সৈয়দ ইসতিয়াক আহমেদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট তাদের মতামতে জানায়, স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ৫৩(এম) অনুযায়ী ৫ শতাংশ উৎসে কর আদায়যোগ্য। আলোচ্য ক্ষেত্রে তা ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্সের আওতায় পড়ে না।
তাই প্রযোজ্য করহারের বিষয়ে এনবিআরের পরামর্শ দেয়ার মতামত দেয় তারা। তানজিব আলম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট মতামতে জানায়, স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত শেয়ার বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল গেইনের জন্য ৫ শতাংশ কর কার্যকর হবে এবং অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে ৫৬(১) অনুযায়ী ১৫ শতাংশ উৎসে কর কার্যকর।
দ্য কনসালটেন্ট মতামতে জানায়, স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত কোম্পানির শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে ক্যাপিটাল গেইনের জন্য ৫৩(এম) ধারা অনুযায়ী ৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে এনবিআরের জারিকৃত ৫ শতাংশ হার কার্যকর হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জিজ্ঞাসা : আইনজীবীদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এনবিআরের কাছে আয়কর আইনের অনিবাসী বিনিয়োগকারীর শেয়ার ধারণের বিষয়ে তিনটি ব্যাখ্যা চেয়েছে। প্রথমত, শেয়ারবাজারে অনিবাসী বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল গেইনের জন্য আয়কর অধ্যাদেশের ৫৩(এম) ধারা অনুযায়ী প্রযোজ্য হারে উৎসে কর দিতে হবে, নাকি ৫৬(১) ধারা অনুযায়ী ক্যাপিটাল গেইনের কর ১৫ শতাংশ প্রযোজ্য হবে।
দ্বিতীয়ত, অনিবাসী বিনিয়োগকারীর ধারণকৃত স্টক ডিভিডেন্টের বিক্রির ক্ষেত্রে অধ্যাদেশের ৫৬(১) ধারা অনুযায়ী ডিভিডেন্ট বাবদ ৩০ শতাংশ করহার কার্যকর কি না? তৃতীয়ত, স্টক ডিভিডেন্ট বিক্রির বিপরীতে ৫৭(২) ধারা অনুযায়ী উৎসে কর কর্তনের ব্যর্থতায় প্রতিমাসে ২ শতাংশ জরিমানা কার্যকর হবে কি না?