করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিতে করপোরেট কর কমানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছর মুজিববর্ষের উপহার হিসাবে পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির কর ছয় বছর পর কমানো হয়। সেই ধারা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত রাখা হচ্ছে। তবে ঢালাওভাবে সব খাতে নয়, আগের মতো উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত শিল্পের কর কমানো হচ্ছে। এ-জাতীয় কোম্পানির কর সাড়ে ৩২ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। বাকি সব খাতের কর অপরিবর্তিত থাকছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক করোনাকালীন বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে স্থানীয় শিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। সেজন্য বাজেটে আকাশচুম্বী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়নি।
চলতি অর্থবছরের মূল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাই আগামী অর্থবছর লক্ষ্য হিসাবে রাখা হয়েছে। যেহেতু লক্ষ্যমাত্রায় বড় পরিবর্তন আসেনি, তাই কর কাঠামোও অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে শিল্পে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। করপোরেট কর এর মধ্যে অন্যতম। শিল্পের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আগামী অর্থবছরও আড়াই শতাংশ কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে।
সূত্রগুলো আরও বলছে, এই মহামারিকালে স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্পকে সুরক্ষার মাধ্যমেই শুধু অর্থনীতির ভিত মজবুত রাখা সম্ভব। কারণ, শিল্প টিকে থাকলে উৎপাদন হবে, রপ্তানি বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। মানুষের আয় বাড়লে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। তাই রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি রেয়াতি সুবিধা, এইচএস কোডের জটিলতা দূর করা হবে।
দেশীয় শিল্পের মধ্যে ইলেকট্রনিক্স, মোটরসাইকেল, ইস্পাত, প্যাকেজিং, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নতুন করারোপ করা হবে না। পক্ষান্তরে অটোমেশন কার্যক্রম জোরদারের মাধ্যমে ব্যবসা সহজীকরণের উদ্যোগ থাকবে বাজেটে। কর আদায় বাড়াতে ভার্চুয়াল ইকোনমি, ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল ও অডিট কার্যক্রমকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এজন্য আয়কর আইনে নতুন ধারা যুক্ত করা হবে।
সর্বোপরি আয়কর আইনকে যুগোপযোগী করে ব্যবসাবান্ধব করা হবে। পাশাপাশি বন্ডের অপব্যবহার বন্ধে অনিয়মের জরিমানা বৃদ্ধি, ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে ইএফডি (ইলেকট্রনিক ফিসকল ডিভাইস) স্থাপন ও সেগুলো মনিটরিং কর্মকর্তাদের রোস্টারভিত্তিক পদায়নের দিকনির্দেশনা থাকবে। আমদানি পণ্যের এইচএস কোড বিভাজন করা হবে।
বিদ্যমান কর কাঠামো অনুযায়ী, করপোরেট করের ৮টি স্তর আছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ২৫ শতাংশ, তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিকে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংককে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ, তালিকাবহির্ভূত ব্যাংককে ৪০ শতাংশ, মার্চেন্ট ব্যাংককে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, সিগারেট, জর্দা ও গুলসহ তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিকে ৪৫ শতাংশ, তালিকাভুক্ত মোবাইল কোম্পানিকে ৪০ শতাংশ ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিকে ৪৫ শতাংশ এবং লভ্যাংশ আয়ের ওপর ২০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। এর বাইরে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানকে ১০ ও ১২ শতাংশ এবং সমবায় প্রতিষ্ঠানকে ১৫ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয়।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বাজেটের রূপরেখা প্রণয়নের সময় করপোরেট কর হ্রাসের পরিকল্পনা থাকলেও রাজস্ব আয়ের কথা চিন্তা করে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। কারণ, আয়কর খাতে উৎসে করের পর করপোরেট কর বেশি আদায় হয়। ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কাছ থেকে আদায় করা করের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য।
এ অবস্থায় ঢালাওভাবে করপোরেট করহার হ্রাস করলে আয়কর আদায় কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়বে-এ বিবেচনায় শুধু উৎপাদনশীল খাতে করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়লে অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। ফলে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাবহির্ভূত কোম্পানি করহার বেশি। এটা কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা উচিত।
তবে এতে খুব একটা সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, শুধু করহারের কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে-এমনটা ঠিক নয়। অবকাঠামো, জ্বালানি, সুশাসনের সূচক, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে উন্নতি করতে না-পারলে শুধু করপোরেট কর কমিয়ে বিনিয়োগের বড় লম্ফন আশা করা অবাস্তব।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নবনির্বাচিত সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, করোনার এই মুহূর্তে করপোরেট কর কমানো হলে ব্যবসার প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়বে এবং ব্যবসায়ীদের মনোবল চাঙা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এজন্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, এটি দেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হয়ে থাকবে। ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে। শুধু তাই নয়, যারা নতুন বিনিয়োগ করতে চান তারাও আগ্রহ নিয়ে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন। করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকতে এই সহায়তা দরকার ছিল।
তিনি আরও বলেন, করপোরেট কর কমানোর পাশাপাশি অন্য যেসব করসংক্রান্ত বাধা আছে সেগুলো দূর করতে পারলে দেশে বিনিয়োগ হবেই। যারা ইতোমধ্যে বিদেশে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন তারাও সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন বলে মনে করি।