দেশে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা উবার ও পাঠাওয়ের মতো অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ন্ত্রণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে এসব সেবাকে করের আওতায় আনা হয়। বাজেট পাসের পর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রদান করতে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠিও দেয় এনবিআর। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জটিলতায় এখনো এ খাত থেকে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। কিছু প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে ভ্যাট দিলেও টার্নওভার নির্ধারণে আটকে আছে প্রক্রিয়াটি। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রমো কোড নামে ডিসকাউন্ট ব্যবস্থা ও চালকদের আয় ভ্যাটমুক্ত হওয়ায় ভ্যাটের নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণে জটিলতায় পড়েছে কোম্পানিগুলো। চালকদের কমিশনে ভিন্নতার পাশাপাশি রাইডপ্রতি ইনসেনটিভ ও কৌশলগত বিপণন বাবদ অনেক বেশি অর্থ ব্যয়ের কারণে কোম্পানির আয় নির্ধারণ জটিল হয়ে পড়ে। ডিসকাউন্ট বা প্রমো অফারের আওতায় অনেক রাইডের বিপরীতেই চালকরা কোম্পানি থেকে টাকা পেয়ে থাকেন। ফলে রাইড হিসেবে কোম্পানির আয় নির্ধারণ সম্ভব হয় না। অন্যদিকে পরিচালন ব্যয়ের আগে মূল টার্নওভার থেকে ভ্যাট নির্ধারিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী ভ্যাট দিতে হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে আয় না হলেও টার্নওভার থেকে ভ্যাট দিতে হবে কোম্পানিগুলোকে। এতে লোকসান গুনতে হয় রাইড শেয়ারিং সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ফলে এ-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে এনবিআরে আবেদন করে উবার বাংলাদেশ লিমিটেড।
উবার বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিসকাউন্ট অফারের কারণে অনেক রাইডের বিপরীতে আয়ের পরিবর্তে উল্টো চালককে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। যদিও প্রতি ১০০ টাকায় এখন ২০ টাকা কোম্পানির আয় হিসেবে ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে, যা সময়ে সময়ে পরিবর্তনশীল। প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির আয় না থাকলেও ভ্যাট প্রদানের কারণে কোম্পানিকে মাশুল দিতে হয়। তাছাড়া চালকদের ইনসেনটিভ ও বোনাস হিসেবে দেয়া রাইডের আয়ও ডাটাবেজে যুক্ত হওয়ায় তাতে ভ্যাট দিতে হয়। ফলে আয় না করেও ভ্যাট প্রদানের কারণে বিপত্তিতে পড়েছে কোম্পানিগুলো। এ অবস্থায় অনেক প্রতিষ্ঠানই ভ্যাট দিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
রাইড শেয়ারিং সেবায় টার্নওভারের হিসাব অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো নয় বলে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এনবিআরও। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট আদায় করলেও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে আপত্তি জানায় কোম্পানিগুলো। ফলে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের ভ্যাটসংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ভ্যাট বিভাগের একটি টিম কাজ করছে। এ বিষয়ে ভ্যাট নীতি শাখার বৈঠক শেষে সম্প্রতি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কিছু তথ্য চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। উবার ও পাঠাওয়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে রাইড শেয়ারের বিপরীতে ডিসকাউন্ট কীভাবে নির্ধারণ হয় তা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মূসক চালানে মোট ভাড়া, ডিসকাউন্ট, কমিশন ও মূসকের পরিমাণসহ যাবতীয় তথ্য আলাদাভাবে উপস্থাপন করতে প্রযুক্তিগত কোনো সমস্যা রয়েছে কিনা এবং রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে অনলাইনে তদারকি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সমস্যা হবে কিনা, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এর বাইরে কোম্পানিগুলো তাদের মোট ভাড়া কীভাবে নির্ধারণ করে সেটাও জানতে চেয়েছে এনবিআর।
এনবিআরের সদস্য (মূসক নীতি) মো. রেজাউল হাসান বলেন, আইন পাসের পরই কোম্পানিগুলো থেকে ভ্যাট আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু করে এনবিআর। তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ও করা হচ্ছে। তবে কোম্পানিগুলোর হিসাব পদ্ধতি ও কমিশন ব্যবস্থার কারণে বিষয়টি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। উবার ও পাঠাওয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের টার্নওভারের বড় অংশই পেয়ে থাকেন চালকরা। চালকদের এ আয় ভ্যাটমুক্ত। ফলে চালক ও কোম্পানিগুলোর কমিশন আলাদা করা নিয়ে ভ্যাট অফিসের কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি সমাধানে উভয় পক্ষকে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে।
কৌশলগত বিপণন ব্যয়ে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে ভ্যাট অব্যাহতির বিষয়ে রেজাউল হাসান বলেন, কোম্পানিগুলো ভ্যাট অব্যাহতি চেয়েছে। তবে সেটি সম্ভব নয়। রাজস্ব আয়ের কথা বিবেচনা করে তারা এ খাতে অব্যাহতি চেয়েছে। আগামী জুলাই থেকে নতুন আইন কার্যকর হলে তখন এটা এমনিতেই অব্যাহতির আওতায় চলে আসবে।
জানা গেছে, পাঠাও-উবারসহ সব অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবার ওপর চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে এনবিআর। তবে এ ভ্যাট আদায় হবে রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য অর্থের ওপর। মোবাইল অ্যাপসভিত্তিক এ সেবার বিপরীতে যাত্রী নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পর চালককে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া পরিশোধ করে থাকেন। এ সেবা মূল্যের বা ভাড়ার একটা অংশ মোবাইল অ্যাপসভিত্তিক সেবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পেয়ে থাকে। ভ্যাট আইনে বর্তমানে সব ধরনের যানবাহন চালকের দেয়া সেবা ব্যক্তিগত সেবা হিসেবে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। রাইড শেয়ারিংয়ের চালকদের আয়ে ভ্যাট অব্যাহতি থাকলেও এ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। তবে কোম্পানিগুলোর প্রমো ও ইনসেনটিভের কারণে অনেক রাইডে কোনো আয় হয় না। উপরন্তু অনেক চালককে উল্টো টাকা পরিশোধ করতে হয় রাইড শেয়ারিং সেবাদাতাদের। ফলে রাইডপ্রতি ভাড়া হিসেবে ডাটাবেজে যুক্ত হলে তা থেকে নিজেদের আয় নির্ধারণ করে ভ্যাট প্রদান করতে পারছে না সেবাদাতারা। ভ্যাট অফিসের চাপে উবার ও পাঠাও ভ্যাট দিলেও বাকিরা তা দিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।