নতুন অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন ভ্যাট আইন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী ১ জুলাই থেকে এ আইন বাস্তবায়ন করা হবে। তবে কিছু অংশ বাজেট ঘোষণার দিন থেকেই বাস্তবায়ন হবে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইনটিতে অনেক সংশোধনী আনা হয়েছে। নতুন আইনে ভ্যাটের স্তর রাখা হয়েছে চারটি। এগুলো হচ্ছে- ৫, সাড়ে ৭, ১০ ও ১৫ শতাংশ। বিভিন্ন সেবা ও পণ্যের ওপর ওই হারে ভ্যাট দিতে হবে ভোক্তাদের। নতুন আইনে বিভিন্ন সেবা ও পণ্যকে যেমন ভ্যাটের আওতায় আনা হয়েছে, তেমনি অনেক খাতে ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বেশকিছু পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার কমানো হয়েছে। বেশকিছু খাতকে ভ্যাটের আওতামুক্ত করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা সরাসরি ভ্যাট সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। কোনো ক্রেতা ভ্যাট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সরকারি কোষাগারে জমা হবে। নতুন আইনে ভ্যাটের অনেক বিষয় অনলাইনে করা যাবে।
যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত রয়েছে সেগুলোতে রেয়াত পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখার জন্য বছরে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভার রয়েছে এমন ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হলে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স দিতে হবে।
ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা ৮০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাটের হার হবে ৫ শতাংশ। ওষুধ ও পেট্রোলিয়ামজাতীয় পণ্যে ভ্যাটের হার আড়াই শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ রাখা হচ্ছে।
সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্প, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও পিপিপির আওতার প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগকারীদের ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে ভারী প্রকৌশল শিল্প, রফতানিমুখী শিল্প, অটোমোবাইল, ফ্রিজার, এয়ার কন্ডিশনার, মোটরসাইকেল, মোবাইল শিল্পসহ কতিপয় শিল্প খাতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক তুলে দেয়া হয়েছে।
পুরনো ভ্যাট আইনে এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, গুঁড়া মসলা, টমেটো কেচাপ, চাটনি, ফলের জুস, টয়লেট টিস্যু, টিউবলাইট, চশমার ফ্রেমসহ নিত্য ব্যবহার্য ৮৬টি পণ্যের ওপর ট্যারিফ মূল্য বহাল ছিল। নতুন আইনে উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ কারণে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
বাজেটে মোট ৫৫টি পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এগুলোতে আগে ট্যারিফ ভ্যালু বহাল ছিল। ফলে এগুলোর দামও বাড়বে। এ ছাড়া কিছু পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল সেগুলোতে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
যে সব পণ্য ও সেবায় ৫ শতাংশ ভ্যাট
প্লাস্টিকের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী, সিআর কয়েল, জি আই ওয়্যার, তারকাটা, স্ক্রু, অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী, ব্লেড, ট্রান্সফরমার, টিউবলাইট, চশমার ফ্রেম, সানগ্লাস, রিডিং গ্লাস, ম্যাটরেস। এ ছাড়া ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, ইন্ডেটিং, আসবাবপত্র, লঞ্চের এসি কেবিন, পরিবহন ঠিকাদার, স্বর্ণ ও রূপার জুয়েলারি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর সেবা ও বিদ্যুৎ বিল।
প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট কর্মকর্তাদের কাজে উৎসাহ যোগাতে নতুন ভ্যাট আইনে আর্থিক পুরস্কারের বিধান রাখা হয়েছে। এ জন্য সংযুক্ত করা হয়েছে নতুন একটি ধারা। পাশাপাশি পুরস্কার নিশ্চিত করতে তহবিল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এর আওতায় আদায় করা রাজস্বের দশমিক ৫০ শতাংশ দিয়ে পুরস্কার ও কর্মদক্ষতা প্রণোদনা প্রদানযোগ্য অর্থের জন্য তহবিল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। বাজটে ভ্যাট কর্মকর্তাদের পুরস্কারের বিধান রাখলেও ব্যবসায়ীদের হয়রানি এবং অসাধু কাজে জড়িতদের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। উল্টো দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে।
আইনে সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম রক্ষণ নামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। এ ধারায় কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, ভ্যাট আইনের অধীনে কোনো কর্মকর্তার কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বা অন্যকোনো আইনগত কার্যধারা দায়ের বা রুজু করা যাবে না।
যে সব সেবায় ১০ শতাংশ ভ্যাট
মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, নিলামকারী সংস্থা, যান্ত্রিক লন্ড্রি, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচ্চিত্র প্রদর্শক (প্রেক্ষাগৃহ), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, সিকিউরিটি সার্ভিস, স্বয়ক্রিংয় বা যান্ত্রিক করাতকল, খেলাধুলা আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার (পেট্রলিয়ামজাত পণ্য ব্যতীত), বোর্ড সভায় যোগদানকারী, টেইলারিং শপ ও টেইলার্স, ভবন, মেঝে ও অঙ্গন পরিষ্কার বা রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, লটারির টিকিট বিক্রয়কারী ও সামাজিক ও খেলাধুলা বিষয়ক ক্লাব।
শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি
রফতানিমুখী তৈরি পোশাককে ভ্যাটের চাপ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক গ্যাস, ওয়াসা, যোগানদার, সিকিউরিটি সার্ভিস, পরিবহন ঠিকাদার, যানবাহন ভাড়া প্রদানকারী, বিদ্যুৎ বিতরণকারী, তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর সেবা, বিদেশি সেবা গ্রহণ, শ্রমিক কল্যাণ ও বিনোদন ব্যয়, ল্যাবরেটরি চার্জ, বন্দর, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স, সিঅ্যান্ডএফ সংস্থা, বীমা কোম্পানি, শিপিং এজেন্ট, বন্দর, টেলিফোন, টেলেক্স, ফ্যাক্স, অগ্নিবীমা, কুরিয়ার সার্ভিস ও ব্যাংকিং সেবার ওপর শতভাগ ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আগে বেশকিছু সেবার বিপরীতে আংশিক ভ্যাট ছিল। একই সুবিধা পাবেন হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা।
এ ছাড়াও মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ফোন, ফ্রিজের কম্প্রেসার উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল থাকবে। পাশাপাশি বাজেটে দেশীয় প্রাইভেটকার ও ওষুধ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়েছে।