আপনার মহল্লার গলিতে একটি মিষ্টির দোকান আছে। বেচাকেনা যাই হোক না কেন, আপনাকে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট নিবন্ধন নিয়ে নিয়মিত রিটার্ন দিতে হবে। যদি ভ্যাটযোগ্য হন, তবে ভ্যাট দিতে হবে। একইভাবে যদি ছোটখাটো রেস্তোরাঁ ব্যবসায় নামেন, তাহলেও ভ্যাট নিবন্ধন নিয়ে রিটার্নও দিতে হবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব রাখতে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) বা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বসাতে হবে। প্রায় পৌনে দুই শ পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবসায় নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা ভ্যাট নিবন্ধন হিসেবে পরিচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত রোববার এই আদেশ দিয়েছে। ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, এমন তালিকায় অনেক ছোট ব্যবসা খাতও ঢুকে পড়েছে। ছোট ব্যবসার তালিকায় আছে রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, আসবাব বিক্রেতা, কোচিং সেন্টার, শরীরচর্চা কেন্দ্র (জিম), বিউটি পারলার, মোটর ওয়ার্কশপ, ডেকোরেটরের দোকান, যানবাহন ভাড়া প্রদানকারী ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধন নিয়েই ব্যবসা শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি রুহুল আমিন এ বিষয়ে বলেন, ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়ার বিষয়টি এনবিআর চাপিয়ে দিচ্ছে। অব্যাহতির সীমার মধ্যে লেনদেন থাকলে কেন ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হবে? ছোট রেস্তোরাঁয় মালিকই হিসাবপত্র রাখেন। এখন ভ্যাট নিবন্ধন নিয়ে ইসিআর মেশিন বসিয়ে হিসাব রাখতে হবে। স্বল্পশিক্ষিত রেস্তোরাঁর মালিকদের পক্ষে তা কোনোভাবে সম্ভব নয়। ১২-১৫ হাজার টাকা মাসিক বেতন দিয়ে হিসাবরক্ষক রাখাও সম্ভব নয় এসব ছোট ব্যবসায়ীর।
১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই নতুন আইনে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভার বা লেনদেন হলে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট নিবন্ধনও নিতে হবে না। আইন চালুর কয়েক দিন পরই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে এনবিআর। অবশ্য রেস্তোরাঁ, বিউটি পারলার, জিম, মিষ্টির দোকানের মতো কিছু কম টার্নওভারের ব্যবসায়ীরা এত দিন প্যাকেজ ভ্যাট দিত। নতুন আইনে প্যাকেজ ভ্যাট দেওয়ার সুযোগ নেই।
তালিকায় আছে রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান, শরীরচর্চা কেন্দ্র, বিউটি পারলার, কোচিং সেন্টার, আসবাবের দোকান ভ্যাট নিবন্ধন নিয়ে ইসিআর মেশিনে হিসাব রাখতে হবে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান আইনটি ভ্যাট আইন বলে কিছু নেই। আবগারি শুল্ক হয়ে গেছে। ভ্যাট আইনে অবশ্যই একটি নির্ধারিত লেনদেন সীমা পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি থাকতে হবে। সীমার নিচে লেনদেন হলে ভ্যাটের আওতার বাইরে থাকবে। নতুন আদেশে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ীকে সীমার নিচে লেনদেন হলেও ভ্যাট নিবন্ধন নিয়ে রিটার্ন জমা দিতে হবে। এসব ছোট প্রতিষ্ঠানের স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাব রাখার সামর্থ্য নেই। এতে হয়রানি বাড়বে।
পাড়া মহল্লায় এখন ছোট ছোট বিউটি পারলার গড়ে উঠেছে। গলিতে গলিতে এসব বিউটি পারলারের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণীরাই এসব পারলারে যান। এসব পারলারের দৈনিক আয়ও খুব বেশি নয়। পারলারের মালিকেরা নিজেরাই বিউটিফিকেশন কোর্স করে পারলার চালান। এখন তাঁদের ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হবে। বড় শহরের তরুণ-তরুণীরা এখন স্বাস্থ্যসচেতন। তাঁদের কথা মাথায় রেখে বড় শহরগুলোতে ছোট ছোট শরীরচর্চাকেন্দ্র বা জিম গড়ে উঠেছে। এসব জিমের মালিকদের ওপর নতুন করে ভ্যাটের খড়্গ পড়ল।
গৃহিণীরা বাড়তি আয়ের জন্য নিজেরাই নকশা করে সালোয়ার কামিজ, শাড়ি, শোপিস বিক্রি করে থাকেন। কোনো শোরুম নেই, বাসাবাড়িই শোরুম। এটি শহরে জীবনে নতুন প্রচলন। বিক্রির মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করেন। এমন শত শত উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছেন। এনবিআর বলেছে, অনলাইনে বেচাকেনা করলেই ভ্যাট নিবন্ধন নিয়ে ভ্যাটের হিসাবনিকাশ রাখতে হবে।
ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার তালিকায় চামড়াজাত পণ্য, দুধজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, কাঠের পণ্য, সুতাসহ বিভিন্ন বড় উৎপাদক আছে। আবার নির্মাণ সংস্থা, ভূমি উন্নয়ন সংস্থা, ভবন নির্মাণ সংস্থা, পরামর্শক সেবা প্রতিষ্ঠান, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স, নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রকৌশলী সেবা প্রতিষ্ঠান, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল, সুপারশপের মতো বড় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানও আছে। আবার সিটি করপোরেশন ও জেলা শহর এলাকার সিমেন্ট, সিরামিক পণ্য, ফ্রিজ, টেলিভিশনসহ ইলেকট্রনিক পণ্য, স্যানিটারিওয়্যার বিক্রেতাদের ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হবে।
এনবিআর সুপারশপের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এসি-ননএসি কিংবা আয়তন যা ই হোক না কেন, আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসম্মত, জীবাণুমুক্ত ও প্রিজারভেটিভবিহীনভাবে মাছ-মাংস, চাল ডাল, শাকসবজি, ফলমূলসহ গৃহস্থালির ও মনোহারি পণ্য বিক্রি করা হয়।
এনবিআরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তালিকায় থাকা বেশির ভাগ বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। তাঁদের বার্ষিক টার্নওভার সাধারণত ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ভ্যাট ফাঁকি রোধে ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে যাঁদের টার্নওভার ৫০ লাখ টাকার কম, এনবিআর চাইলে ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাটের টাকা আদায় করতে পারে।