ইআরডি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী বাড়ছে দেশি-বিদেশি ঋণের ঝুঁকিজুন নাগাদ আয়কর রিটার্ন ৪৫ লাখে উন্নীত হবেউল্কা গেমসের কর ফাঁকির ৫০ কোটি টাকা আদায়ে ব্র্যাক ব্যাংকে এনবিআরবাজেটের আকার কমানোর পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলইরানের তেল রফতানিতে বাধা নেই
No icon

বাংলাদেশের প্রধান আমদানির উৎস চীন

পণ্য আমদানির উৎস হিসেবে এক সময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দের দেশ ছিল ভারত, তবে এক যুগ আগেই তা পাল্টে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে চীনা পণ্যের যে দাপট চলছে বাংলাদেশের বাজারে, এখনো তা বজায় আছে। অর্থাৎ পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দের দেশ চীন। আর ভারত এখন দ্বিতীয় পছন্দের দেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য জানাচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানি করা পণ্যের ২৭ শতাংশের বেশি এসেছে চীন থেকে। আর একই অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানির হিস্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩৪ বছরের আমদানি পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ভারত থেকে বাংলাদেশে ১০ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য এসেছিল। ওই অর্থবছরে ১১ কোটি ডলারের পণ্য আসে চীন থেকে। এর পর থেকে টানা ২০০৪-০৫ অর্থবছর পর্যন্ত ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি চীনের তুলনায় বেশি ছিল। 

২০০৫-০৬ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ভারতকে টপকে যায় চীন। ওই অর্থবছরে ১৮৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য ভারত থেকে আমদানি হলেও চীন থেকে আসে প্রায় ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য। পরের ২০০৬-০৭ অর্থবছরেও চীন ছিল প্রথম, ভারত দ্বিতীয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঠিক মাঝামাঝি সময়, অর্থাৎ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে চীনের বদলে ভারত আবার বাংলাদেশের বাজারে প্রথম অবস্থান দখল করে।

কিন্তু ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে পরিস্থিতি আবার পাল্টে যায়। ওই বছরের পর থেকে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানিতে ভারত আর কখনোই চীনকে টপকাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয় ৩২১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পণ্য, আর চীন থেকে আমদানি হয় প্রায় ৩৮২ কোটি ডলারের পণ্য। এভাবে চলতে চলতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে ভারতের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি পণ্য আমদানি হয় চীন থেকে। ওই অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয় ৫৭২ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য, আর চীন থেকে আসে ১ হাজার ৫৫৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য।

কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হলে এর প্রভাবে উভয় দেশ থেকেই পণ্য আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে যায়। যেমন ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের মূল্য ছিল ৬৬৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার, অন্যদিকে চীন থেকে আমদানি হয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরের তুলনায় ভারত থেকে এ অর্থবছরে আমদানি কমে ১৫৮ কোটি ডলার ও চীন থেকে ২৯০ কোটি ডলার।

তবে কোভিড একটু দুর্বল হয়ে এলে উভয় দেশ থেকেই ব্যাপকভাবে বাড়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয় ১ হাজার ৫১৮ কোটি ডলারের পণ্য। ওই বছর চীন থেকে আমদানি হয় ২ হাজার ৪২৫ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানি দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলারে। অথচ ঠিক আগের অর্থবছরে মোট আমদানি হয়েছিল ৬ হাজার ৫৫৯ কোটি ডলারের পণ্য।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ এক সময় মূলধনী যন্ত্রপাতি বেশি আনত জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া—এসব দেশ থেকে। অর্থনীতির বৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে চীন যখন প্রতিযোগিতামূলক দামে বিভিন্ন মানের পণ্য উৎপাদনের দিকে গেল এবং প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশের শিল্পায়নেও গতি এল, তখন সংগত কারণেই চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি বেড়ে গেল।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ১ নম্বর অবস্থান ভারতের বদলে চীনের হলেও ভারত থেকেও কিন্তু আমদানি বেড়েছে। ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার—উভয় মুদ্রার বিপরীতেই চীনা মুদ্রা ইউয়ানের দাম দেশটির সরকার ধরে রেখেছিল। অর্থাৎ ইউয়ানের মান বাড়তে দেয়নি। এ বিষয়টিও দেশটির প্রায় সব পণ্যকে প্রতিযোগিতামূলক করেছে, যার সুবিধা শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারতীয় আমদানিকারকেরাও পেয়েছেন।
শীর্ষ ১০ দেশ কোনগুলো

আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মোট আমদানি ব্যয়ের বড় অংশ ব্যয় হয় জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, গম, সার, কাঁচা তুলা, সুতা, মূলধনী যন্ত্রপাতি ইত্যাদি পন্য কেনার ক্ষেত্রে। যেসব দেশ থেকে এসব পণ্যের বড় অংশ আমদানি করা হয়, সেই তালিকায় শীর্ষ ১০ দেশ হচ্ছে—চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও অনেক পণ্য আমদানি হয়।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রধানত প্রাথমিক পণ্য, শিল্পজাত পণ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতি—এ তিন শ্রেণিতে বেশি পণ্য আমদানি করে। প্রাথমিক পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, গম, তৈলবীজ, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও কাঁচা তুলা। আর শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল, সার, ক্লিংকার, স্টেপল ফাইবার ও সুতা। ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি তাসকিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে বাংলাদেশ মূলত খাদ্যপণ্য আমদানি করে আসছিল।

মাঝে খাদ্যপণ্যের কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। ফলে এসব পণ্যের আমদানি নির্ভরতা অনেকটাই কমেছে। আর এটা খুব স্বাভাবিক যে চীন এখন বাংলাদেশের প্রধান আমদানি উৎস হবে। কারণ, ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যেই দেশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের জন্য চীনের বিকল্প এ সময় কেউ হতে পারে না। তাসকিন আহমেদ আরও বলেন, রাস্তাঘাটসহ বড় বড় সেতু নির্মাণের পণ্যের জন্যও চীনের প্রতি নির্ভরতা রয়েছে বাংলাদেশের। ফলে দেশটি থেকে পণ্য আমদানি বাড়বেই। 
চীন ও ভারত থেকে কী আনা হয় 

চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতিই বেশি। বাংলাদেশ অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ আর পোশাক তৈরির বেশির ভাগ কাঁচামালও আসে চীন থেকে। এ ছাড়া বয়লার, তুলা, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, সুতা, লৌহ, ইস্পাত ইত্যাদি পণ্যও আমদানি করা হয় চীন থেকে। আর ভারত থেকে বেশি আনা হয় খাদ্যপণ্য। যেমন—চাল, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি ইত্যাদি। মাঝেমধ্যে কাঁচা মরিচের মতো পণ্যের সংকটেও ভারতের শরণাপন্ন হতে হয় বাংলাদেশকে। তবে কিছু যন্ত্রপাতি ভারত থেকেও আসে, যদিও পরিমাণে তা চীনের কাছাকাছিও নয়।

তাসকিন আহমেদের মতো প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন বাংলাদেশ চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধাও। তিনি বলেন, যে যা–ই বলুন না কেন, শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য কম দামে ভালো মানের পণ্য তৈরি করে চীনই। বাংলাদেশ ১৫ থেকে ২০ বছরে ব্যাপক শিল্পায়নের দিকে গেছে, ফলে চীন যে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির প্রথম উৎসস্থল হবে, এটা খুবই স্বাভাবিক।