সামনের মাসটি বাজেটের। জুনেই অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব করেন এবং তা আলোচনা-সমালোচনা, সংযোজন-বিয়োজন শেষে মাসের শেষ সপ্তাহে তা চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। যেহেতু সংসদ আমজনতার সমাবেশ নয়, তাই অর্থমন্ত্রী বাজেট বিষয়ে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে একটা প্রাক-বাজেট আলোচনা সেরে নেন। যদিও শেষতক দেখা যায়, সরকারের চাওয়া-পাওয়াটাই বেশি প্রাধান্য পায়। সুধীজনের সঙ্গে যে আলোচনাগুলো হয় তা পূর্ণাঙ্গ নয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একটি সম্পূর্ণ ‘বিকল্প’ বাজেট প্রস্তাবের প্রচলন করে। গত বছর ২৬ মে সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. আবুল বারকাতের নেতৃত্বে কার্যনির্বাহী কমিটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে একযোগে কনফারেন্সের মাধ্যমে বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছিল। সরকার তার স্বভাবসুলভভাবেই প্রস্তাবের যথার্থ প্রতিফলন ঘটায়নি।
তা হোক; তবে বাজেটের যে একটা নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি থাকতে হয় তা আমরা সমিতির প্রস্তাব থেকে জেনেছি। সাধারণ মানুষ যা মনে করেন তা হল বাজেট মানে একটি দেশের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব; এটি একটি গাণিতিক যোগ-বিয়োগের ব্যাপার। আদতে তা নয়। কোন উৎস থেকে আয় করব, কোন খাতেই বা তা ব্যয় করব তার একটি দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। সেটি জনমুখী, না কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠীমুখী তার একটা স্বচ্ছ প্রতিফলন দরকার। অর্থনীতি সমিতির এটাই হচ্ছে উল্লেখ করার মতো দিক।
আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতি হল : ১. জাতীয়তাবাদ, ২. সমাজতন্ত্র, ৩. গণতন্ত্র ও ৪. ধর্মনিরপেক্ষতা। প্রতিটি নীতিকে আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা না করেও যেটি দাঁড়ায় তা হল একটি অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার সঙ্গে একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা তৈরি করা এবং তা অবশ্যই পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক চর্চার ভেতর দিয়েই করতে হবে। আমাদের বাজেটের দর্শনভিত্তি এমনটি হলেই যথার্থ হবে। বিগত ৪৮ বছরের বাজেটগুলো আমাদের মূলমন্ত্রের প্রতি যত্নবান হয়নি। বৈষম্যহীন অর্থনীতির স্বপ্ন বৈষম্যের ভারে নুয়ে পড়েছে।
সরকারের তরফ থেকে বলা হয়ে থাকে, দারিদ্র্যের হার ৩১ থেকে ২৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু গবেষণার ফল বলছে, দারিদ্র্যের হার এখনও ৬৬ শতাংশের নিচে নয়, মধ্যবিত্ত রয়েছে ৩১.৩ শতাংশ, বাদবাকি ২.৭ শতাংশ হল ধনিকগোষ্ঠী। ভয়ংকর কথা হল, বিগত ৩০ বছরে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ দরিদ্রের খাতায় নাম লিখিয়েছে। বাজেট পেশের আগে মন্ত্রীমহোদয় যাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন তা হল ওই ২.৭ শতাংশ মানুষের কথা এবং তাদের স্বার্থ বিবেচনায় থাকে বেশি।
এ বৈষম্যচিত্রটি বাজেট ভাবনায় না থাকাটা দুঃখজনক। দিন দিন মানুষ যত বাড়ছে, দরিদ্র জনসংখ্যা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি হারে। গত ৩০ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ৬০ শতাংশ আর দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। আগামীকাল যদি ১০০ মানুষ জন্ম নেয় তবে তার ৭৭ জনই অতি দরিদ্র। এ দরিদ্রের আবার ৮২ শতাংশ গ্রামে বাস করে, বাকিরা শহরে। সে গ্রাম আবার কেমন গ্রাম, যেখানে ৬০ শতাংশ খানাই (household) ভূমিহীন।
সেখানে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পায় না ৬০ শতাংশ আর বিদ্যুৎ সংযোগ নেই ৪০ শতাংশের। সুতরাং আয়বৈষম্যের দিকটি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। নতুবা মানুষ দিন দিন হতাশাবাদী থেকে ধর্মাশ্রিত উগ্রবাদীতে পরিণত হবে। যে মানুষ একের পর এক বঞ্চনার শিকার হয় সে সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি ও তার স্থিতিশীলতার প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে যে কোনো অবিবেচনার কাজও করতে পারে। এটি রাষ্ট্রকে এবং তার সরকারকেই দেখতে হবে এবং তা বাজেটের ভেতর দিয়েই।
অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে যে শুধু গরিবদেরই সমস্যা হয়েছে তা নয়, ধনীদের মধ্যে আবার একটা শ্রেণী তৈরি হয়েছে, যাদের বলা হয় ‘সুপার ধনী’। এই ‘সুপার ধনী’ হল ধনীদের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ, যারা ধনীদের মোট সম্পদের ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এরা নিজেরা কোনো উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকে না। বিভিন্ন ধরনের কমিশন, দখল-বেদখল আর পারমিট বিক্রয়কারী। আমরা এদের বলি ‘রেন্ট-সিকার’। এরা অর্থনীতিতে কোনো সম্পদ তৈরি করে না; কিন্তু অর্থবিত্ত বাড়ানোর যত কৌশল-অপকৌশল আছে, তা প্রয়োগ করে থাকে। তাদের দাপটই এ সমাজে সর্বময়। এর প্রতিকারের বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও বাজেটে একটি যথার্থ পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।
আমাদের দেশে কৃষক ফসল ফলায়; কিন্তু ফসলের সুফল ভোগ করতে পারে না, মধ্যস্বত্বভোগীরা তার সম্পূর্ণ সুফল ভোগ করে। বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ কৃষকের নেই। মধ্যস্বত্বের উপস্থিতি অনিবার্য তবে তা কৃষককে বাঁচিয়ে রেখে করাটাই সমীচীন। সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য কেনার যে প্রক্রিয়া-পদ্ধতি চালু আছে তা কোনোভাবেই স্বচ্ছ নয় বরং ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের প্রভাবে দুষ্ট- বলতে পারেন ‘পাতি রেন্ট সিকার’।
‘মৌলবাদের অর্থনীতি’র ধারণাটি নতুন হলেও এর প্রবলতা বিশাল। প্রফেসর ড. আবুল বারকাত বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ২০১৬ সালের নিট মুনাফার একটা খতিয়ান দিয়েছেন। তাতে দেখা যায়, মৌলবাদীরা মোট ৩১৬২ কোটি টাকার মুনাফার মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৮৭৮ কোটি (২৭.৮ শতাংশ); বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৩৭ কোটি (১০.৭ শতাংশ); ঔষধ শিল্প, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৩১৬ কোট (১০ শতাংশ); শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২৯৮ কোটি (৯.৪ শতাংশ); যোগাযোগ ও পরিবহন যেখানে রিকশা থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ পর্যন্ত আছে, সেখান থেকে মুনাফা হয়েছে ২৩৪ কোটি (৭.৪ শতাংশ); রিয়েল এস্টেট থেকে ২৫৩ কোটি (৮ শতাংশ); সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যম থেকে ২৩৩ কোটি (৭.৪ শতাংশ) আর বেসরকারি সংস্থা ও সামাজিক সাংস্কৃতি সংগঠনগুলো থেকে ৬১৩ কোটি (১৯.৪ শতাংশ) টাকার মুনাফা করেছে। (সূত্র : ‘বাংলাদেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্দর-বাহির’; পৃষ্ঠা : ১৪০)।
এখানে টাকার অঙ্কটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে খাতগুলো অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই যা মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রভাবের বাইরে। বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টির মোট আর্থিক শক্তিকে এক করলেও তা মৌলবাদের ধার ঘেঁষতে পারবে না। এ অবস্থায় অসাম্প্রদায়িকতার প্রচারক আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির একটা সুস্পষ্ট প্রতিফলন বাজেটে থাকা উচিত।
বাজেটের আরেকটি দিক থাকে, যা খুবই ধোঁয়াশাপূর্ণ; তা হল বরাদ্দ। কোন খাতে বরাদ্দ বেশি দেয়া হয়েছে, তা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা। ধরা যাক, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয় হল ১০ টাকা আর পরিবহন খাতে ৭ টাকা। অঙ্কের হিসাবে ১০ অবশ্যই ৭-এর বড়, তাই বলবেন শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বেশি। কিন্তু কথা হল, প্রকৃত প্রয়োজনের তুলনায় তা কতখানি? শিক্ষা খাতে প্রয়োজন ছিল ৫০ টাকা, আপনি দিয়েছেন ১০ টাকা, তার মানে হল ২০ শতাংশ প্রয়োজন মেটাতে পেরেছেন। অপরদিকে পরিবহন খাতে প্রয়োজন ছিল ২০ টাকার, আপনি দিয়েছেন ৭ টাকা, তার মানে ৩৫ শতাংশ প্রয়োজন মেটানো হয়েছে। আমরা শুধু বরাদ্দের পরিমাণটাই বুঝতে পারি, প্রকৃত প্রয়োজনের বিষয়ে অন্ধকারে থাকি।
আমি জানি, সরকারবিরোধীরা বাজেট সম্পর্কে দলীয় প্যাডে এতক্ষণে লিখে ফেলেছেন, ‘এ বাজেট গণবিরোধী’। পাশাপাশি আওয়ামী লীগও পিছিয়ে নেই, তারাও লিখে ফেলেছেন, ‘এ বাজেট গরিববান্ধব’। দু’দলেরই পুঁজি হল গরিব। কেননা একজন রাষ্ট্রপতির ভোটের ওজন একজন রিকশাওয়ালার ভোটের ওজনের সমান। বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব ও অভিব্যক্তি কতটা জনমুখী, এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অনেক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টই তাদের কাছে জমা আছে।
আমি অবাক হয়ে দেখি, সরকার ও সমাজব্যবস্থার ওপর জনমানুষের আস্থাহীনতা, সব ব্যাপারেই তাদের ম্রিয়মাণতা-অনীহা। যদি বলি সরকারি দলের নেতাদের ‘উন্নতির’ আশ্বাস ক্রিয়াকালের বিচারে কী, তারা বলেন, ‘ফিউচার ইম্পসিবল টেন্স’। সহকর্মীদের যদি বলি, আমাদের ভিসিরা কেমন টকশো করেন, জবাবে বলেন, ‘বিটিভির দুপুরের সংবাদ’। সব মিলিয়ে একটা হতাশা আর আস্থাহীনতার প্রচ্ছায়া। দেশকে, সমাজকে কেউ ‘ওন’ করতে চাচ্ছে না। ব্যক্তিগত পাওয়াটার প্রতিই সবার দৃষ্টি। বাজেট নিয়েও তাদের মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই। সরকার সবকিছু মানিয়ে নেয়ার পরিবর্তে মাড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করায় এমনটি হয়েছে।
কিন্তু হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। বেশ কয়েকটা সূচকে আমরা ভালো অবস্থানে আছি। মাথাপিছু আয় ১৭০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৭ শতাংশ, নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান ভালো। প্রত্যাশিত আয়ু, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান সমন্বয়ে তৈরি মানব উন্নয়ন সূচক আমাদের ০.৬০৮। যদিও তা ভারত (০.৬৪০) ও শ্রীলংকার (০.৭৭০) চেয়ে কিছুটা কম এবং সুইডেন (০.৯৩৩) থেকে অনেকখানি পিছিয়ে, তবুও আপাতত এটাকে খারাপ বলা যাবে না। এ সূচকগুলোর ওপর ভর করে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। প্রয়োজন হল যথার্থভাবে অনুধাবন করে বাজেট প্রণয়ন করা।
আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনকে সামনে রেখে বাজেট ভাবনার প্রয়োজন নেই; আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, আমাদের জাতীয় চেতনার মূলনীতি সামনে রেখেই তা করতে হবে। সেক্ষেত্রে অর্থনীতি সমিতির দৃষ্টিভঙ্গিটি খুবই গ্রহণযোগ্য। তা হল, ‘দেশের মাটি থেকে উত্থিত উন্নয়ন দর্শন বৈষম্য-অসমতা হ্রাসকারী মানবিক উন্নয়ন দর্শন।’ এ আলোকে বাজেট হলেই ভালো ফল পাওয়া যাবে।