রপ্তানি শুরুর ছয় মাসের মাথায় চারটি চালানে চীনে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বিলেট রপ্তানি করেছে জিপিএইচ ইস্পাত, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৯০ কোটি টাকা।
গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে প্রথম বিলেট রপ্তানি শুরু হয় ইস্পাত পণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশ চীনে। রপ্তানি শুরুর ছয় মাসের মাথায় চারটি চালানে দেশটিতে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বিলেট রপ্তানি করেছে জিপিএইচ ইস্পাত, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৩৯০ কোটি টাকা। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছে কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তির মাধ্যমে ইস্পাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে এমএস পণ্যের মতো ভারী শিল্পপণ্য নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের ভারী শিল্প পণ্য রপ্তানি শুরু হয় ২০০৭ সালে, শিপ বিল্ডিং খাতের মাধ্যমে। শুরুতে বিপুল সম্ভাবনা দেখালেও পরে এ খাতের বিকাশ থমকে গেছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে। গত ১৩ বছরে খাতটি মাত্র ১২০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করতে সক্ষম হয়েছে।
জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক (ফাইন্যান্স) কামরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত ৬ মাসে জিপিএইচ ইস্পাত চীনে ৫০ মিলিয়ন ডলারের এমএস পণ্য রপ্তানি করেছে। চলতি অর্থবছরের বাকি সময়ে আরও ১৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হবে। সরকারের সহযোগিতা পেলে আগামী বছরগুলোতে ২৫০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করা সম্ভব হবে। চীন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি জানান, বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও কাঁচামাল আমদানিকালে এক দফা ফ্রেইট পরিশোধের পর রপ্তানির সময় আরেকবার ফ্রেইট ব্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের পরিচিতি না থাকায় রপ্তানির বাজার সৃষ্টিতেও বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এমএস পণ্য রপ্তানির বিপরীতে ১৫% হারে নগদ সহায়তা চেয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত।
দেশে ইস্পাতপণ্যের কাঁচামালের ৬০-৭০ শতাংশই আমদানি হয়। বাকিটা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আগেও এমএস পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তবে তার পরিমাণ ছিল খুবই কম। গত চার বছরে এমএস পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ যে পরিমাণ আয় করেছে, গত ছয়মাসে জিপিএইচ ইস্পাত একাই তার চেয়ে বেশি পরিমাণ রপ্তানি করেছে। বিশ্বসেরা পিওর অ্যান্ড ক্লিন কোয়ান্টাম প্রযুক্তির কন্সট্রাকশন স্টিল উৎপাদন করে জিপিএইচ ইস্পাত, আন্তর্জাতিক বাজারে যার বিপুল চাহিদা রয়েছে।
ইপিবির তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এমএস পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ আয় করে ০.৯৫ মিলিয়ন ডলার, যা পরের বছর বেড়ে দাঁড়ায় ১০.১৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আরও বেড়ে ১১.৩৯ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার পর কোভিড পরিস্থিতির কারণে গত অর্থবছর তা আবার কমে ০.৮২ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
কামরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ আগে থেকেই এমএস পণ্য রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে, তা মূলত দেশের ভেতরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে রপ্তানি হয়েছে। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ইপিজেডগুলোতে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো এসব পণ্য কিনেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে শুধু জিপিএইচ ইস্পাতের পণ্যই।
ইস্পাত শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ২১০টি এমএস পণ্য উৎপাদনকারী মিল রয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি প্রতিষ্ঠান স্ক্র্যাপ থেকে বিলেট এবং বিলেট থেকে এমএস রড উৎপাদন করে। ৬৩টি প্রতিষ্ঠান ইনগট প্রস্তুত করে ৪০ গ্রেড রড উৎপাদন করে। অন্যরা শিপ ব্রেকিং প্লেট থেকে সরাসরি রড, এঙ্গেল ও বার উৎপাদন করছে।
বছরে বাংলাদেশে এমএস পণ্যের চাহিদা রয়েছে ৬ মিলিয়ন টন। অন্যদিকে এমএস পণ্যের স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা ৮.৫ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ, দেশের চাহিদা মেটানোর পরও বছরে ২.৫ মিলিয়ন টন এমএস পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
জিপিএইচ ইস্পাতসহ স্থানীয় কয়েকটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান চীনে বিলেট রপ্তানির আদেশ পেয়েছে উল্লেখ করে এমএস পণ্য রপ্তানিতে ১৫% নগদ সহায়তা চেয়ে গত ২৮ এপ্রিল অর্থবিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে চিঠি দিয়েছেন জিপিএইচ ইস্পাতের কনসালট্যান্ট এম এ মালেক।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত বছর নভেম্বরে চীনে প্রথম চালান রপ্তানির পরপরই এমএস পণ্য রপ্তানির বিপরীতে ১৫% হারে নগদ সহায়তা দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছিল বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি অর্থ বিভাগ।
জিপিএইচ ইস্পাতের কর্মকর্তারা জানান, তাদের ব্যবহৃত প্রযুক্তির মাধ্যমে ৯০০ গ্রেডের ইস্পাত পণ্য উৎপাদন সম্ভব। দেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর চাহিদা অনুযায়ী তারা এখন ৫০০-৫৫০ গ্রেড স্টিল উৎপাদন করছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে এগুলো ব্যবহার হচ্ছে।
২০০৬ সালে যাত্রা শুরু করা জিপিএইচ ইস্পাত ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত একটি পাবলিক কোম্পানি।