বঙ্গবন্ধুর নামে থাকা প্রতিষ্ঠানে অনুদানে করছাড় বাতিল করছে সরকারখেজুর আমদানিতে শুল্ক-কর কমলদেশে উৎপাদিত প্রসাধনীতে করের বোঝা, আমদানিতে ছাড়ভোজ্যতেল আমদানিতে কমলো ভ্যাটখেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশ
No icon

গোয়েন্দা পুলিশের শক্ত জালে আটকা পড়েছে ৩০ জন বন্ড চোরাকারবারি

 গোয়েন্দা পুলিশের শক্ত জালে আটকা পড়েছে প্রথম সারির অন্তত ৩০ জন বন্ড চোরাকারবারি। ইসলামপুরে ওপেন সিক্রেট বন্ড চোরাকারবার
চিহ্নিত হলেও শীর্ষ বন্ড গডফাদাররা অধরা । যাদের অনেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাপড় আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। কেউ কেউ একেবারে ফুটপাত থেকে উঠে এসে এখন শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
অঢেল টাকার জোরে সমাজের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে রয়েছে তাদের গভীর সখ্য। এ কারণে ডিবি পুলিশ যখন এসব চিহ্নিত বন্ড চোরাকারবারিদের আটক করতে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে, তখন তাদের গ্রেফতার ঠেকাতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রভাবশালীরা। শুল্কমুক্ত কাপড় চোরাচালানে অস্তিত্ব সংকটে রপ্তানিমুখী দেশীয় শিল্প । অথচ এদের কারণে আজ দেশের রপ্তানিমুখী কাপড়ের মিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এসব চোরাকারবারির কারণে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।

অভিযোগ রয়েছে, রপ্তানিমুখী গার্মেন্টের জন্য শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাপড়ের বেশির ভাগ বিক্রি করে দেওয়া হয় খোলাবাজারে। শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কমে বিক্রি করেও চোরাকারবারিরা বিপুল অঙ্কের লাভের মুখ দেখে। এদের কারণে অনেক ভালো ব্যবসায়ীদের সুনাম যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি তারা সৎভাবে ব্যবসা করে মার খাচ্ছেন।

চোরাই কাপড় বিক্রির প্রধান আখড়া পুরান ঢাকার ইসলামপুর। অনেকের কাছে একনামে পরিচিত ইসলামপুর হাট। সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে দেখা যাবে, এখানে শত শত দোকানে ঠাসা দেশি-বিদেশি কাপড়। কোনটা সাধারণ আর কোনটা চোরাই, তার পার্থক্য করা কেবল দুষ্করই নয়, অসম্ভব বটে। কারণ ইসলামপুরে ঢুকলেই চোরাই কাপড়ে বৈধতার সিল পড়ে। অর্থাৎ বৈধভাবে আমদানি করার জাল কাগজপত্র সব সময় প্রস্তুত করা থাকে। তবে এখানে চোরাকারবার চলছে অনেকটা ওপেন সিক্রেট স্টাইলে।

সূত্র বলছে, রাত গভীর হলে একের পর এক আসতে থাকে চোরাই কাপড় ভর্তি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি। টর্চের স্বল্প আলোয় লোড-আনলোডের কাজ শেষ হয়। এক বা দুদিন নয়, রীতিমতো বছরের পর বছর ধরে চলছে এ অনিয়ম। মনিটরিংয়ের দায়িত্ব যাদের-তারা বসে আছেন হাত গুটিয়ে। আবার মাসোহারায় ম্যানেজ হয়েছেন অনেকে।

সম্প্রতি এক অভিযানে কোটি টাকা মূল্যের বন্ড কাপড় ধরা পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। অনস্পট গ্রেফতার করা হয় ১১ জনকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ এ অভিযান চালায়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে ইসলামপুর এলাকার শীর্ষ বন্ড চোরাকারবারিদের নাম বেরিয়ে আসে। যাদের গ্রেফতার করতে পুলিশ প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এমনটি জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র।

ডিবির উপকমিশনার রাজিব আল মাসুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বন্ড কাপড় চোরাকারবারিদের গ্রেফতার করা ডিবির নিয়মিত কাজের মধ্যে পড়ে না। এজন্য বন্ড কমিশনারেট বা শুল্ক গোয়েন্দার মতো পৃথক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু তথ্য-প্রমাণসহ চোরাকারবারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে বিষয়টি উপেক্ষা করাও সম্ভব হয় না। কারণ এভাবে শুল্কমুক্ত কাপড় খোলাবাজারে বিক্রির ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশ বন্ড চোরাকারবারের গডফাদারদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই এ বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে অভিযান চালানো হবে।’

সূত্র জানায়, বেশ কয়েকজন বন্ড চোরাকারবারি শূন্য থেকে এখন রীতিমতো কোটিপতি। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন সোহেল আহমেদ। পরিচিত মহলে তাকে মোটা সোহেল বলে ডাকা হয়। আগে তিনি ভাতের হোটেল ব্যবসা করতেন। কিন্তু ইসলামপুরে বন্ড কাপড় চোরাকারবারের সুবাদে কয়েক বছরেই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ব্যবসা শুরু করেন চীন ও থাইল্যান্ডে। তার পরিবারের সদস্যরা সম্প্রতি স্থায়ীভাবে আবাস গড়েছেন কানাডায়।

চোরাকারবারের অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে শনিবার মুঠোফোনে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে চোরাকারবারের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা মোটেও সত্য নয়। বরং তিনি বৈধভাবে সব ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করে আসছেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

এ ছাড়া চোরাকারবারি হিসাবে গোয়েন্দা তালিকায় নাম আছে আওলাদ হোসেন ওরফে আওলাদ চেয়ারম্যান ও হাজি মোমিন আলীর নাম। এদের মধ্যে মোমিন আলী শ্রীনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন এবং আওলাদ হোসেন ছিলেন শ্রীনগরের তন্তুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। দুজনই মুন্সীগঞ্জের বিএনপি নেতা।

চোরাই বন্ড কাপড় ব্যবসার অভিযোগ অস্বীকার করে হাজি মোমিন আলী বলেন, ‘তিনি বন্ড কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। কারণ তার বন্ডেড লাইসেন্স নেই। তিনি ঝামেলামুক্ত মানুষ। তবে বিদেশ থেকে কাপড় আমদানির ব্যবসা রয়েছে তার। তিনি এর কোনো সাতপাঁচ বোঝেনও না।’ এছাড়া ব্যবসায়ী আওলাদ হোসেন ওরফে আওলাদ চেয়ারম্যানের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র বলছে, ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী জাকির হোসেন ওরফে জাপানি জাকিরের বিরুদ্ধে বন্ড কাপড়ের চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। শুল্কমুক্ত কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করে তিনি অঢেল টাকার মালিক বনে গেছেন। রাজধানীর পরীবাগে দিগন্ত অ্যাপার্টমেন্টে ২টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বনশ্রী আবাসিক এলাকায় বাড়ি আছে তার। অথচ এক সময় চোরাচালানের লাইনম্যান হিসাবে কাজ করতেন তিনি। পরে নিজেই বন্ড কাপড়ের অবৈধ ব্যবসা খোলেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে জাকির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘তিনি একজন আমদানিকারক। কাপড় আমদানির বৈধ ব্যবসা রয়েছে তার। কখনোই তিনি বন্ডের চোরাকারবার বা এ ধরনের বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’

ইসলামপুরে জামাল ও সাকিল নামের দুই চোরাকারবারি প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত। কারণ তাদের সঙ্গে স্থানীয় থানা পুলিশের হট কানেকশন। পুলিশ ও সিআইডির লাইনম্যান হিসাবে কাজ করেন তারা। এছাড়া প্রভাবশালী চোরাকারবারির তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিক্রমপুরের আওলাদ ওরফে ছোট আওলাদ, জনৈক খোকা, শাহাব উদ্দিন, মিন্টু ওরফে জামাই মিন্টু, বকুল ওরফে রাজশাহীর বকুল, বোরকা আজিজ, মাতিন, আব্দুর রব, শাহ আলম ওরফে নয়ন এবং রুবেল, হাজি রহিম, শাহিন ওরফে ঠোঁটকাটা শাহিন, আনোয়ার মোল্লা, কাইয়ুম ওরফে বিজি কাইয়ুম, বোরকা আজিজ, আসলাম, ইসলামপুরের পাভেল, টাওয়ারের আলমগীর-মামুন, মাতিন, রেজা রোমান গং এবং ইলিয়াস অন্যতম।

এদের মধ্যে রেজা রোমান গং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মধ্যে কিছুদিন ব্যবসা বন্ধ রাখলেও এখন আরও বেপরোয়া। এছাড়া ইসলামপুরের এক সময়ের বাংলা ব্যবসায়ী (দেশীয় কাপড়) জনৈক রাজিব ওরফে ভাগিনা রাজিবের বিরুদ্ধে চোরাকারবারের অভিযোগ রয়েছে। চীন থেকে আমদানিকৃত বন্ড সুবিধার কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে রাজিব চক্র। এছাড়া ইসলামপুরে এক সময় চোরাই কাপড় মাথায় করে টানতেন কালাবাবু নামের এক চোরাকারবারি। কিন্তু এখন তিনি নিজেই ব্যবসা খুলেছেন। তার চোরাই বন্ড কাপড়ের ব্যবসা রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠেছে।কাপড় আমদানির সময় কৌশলে এইচএস কোড বদলেও বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন চোরাকারবারিরা। যেমন জ্যাকেটের ঘোষণা দিয়ে আনা হচ্ছে কম্বল। খোঁকা ওরফে 

সূত্র বলছে, পেশাদার চোরাকারবারি ছাড়াও বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা এবং খোদ বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির কতিপয় নেতা বন্ড কাপড়ের চোরাই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। যারা চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এদের মধ্যে এক কর্মকর্তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল। তিনি এ সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী হোতা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন নিরপেক্ষভাবে এদের সম্পদের অনুসন্ধান করলে বিস্তর প্রমাণ পেয়ে যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিবির অভিযানের পর বড় মাপের বন্ড চোরাকারবারিদের অনেকে ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছেন। গ্রেফতার এড়াতে কেউ কেউ মোবাইল ফোন বন্ধ করে চলে গেছেন অজ্ঞাত স্থানে। তবে আত্মগোপনে থাকা বেশ কয়েকজন চোরাকারবারিকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। অবশ্য তাদের পক্ষে  আসছে প্রভাবশালী মহল ।

ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেসার উদ্দিন মোল্লা সোমবার বলেন, ‘ইসলামপুরে বন্ড কাপড়ের চোরাকারবার বন্ধে বস্ত্র সমিতির পক্ষ থেকে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে চোরাকারবার এখনো বন্ধ হয়নি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। চোরাকারবার বন্ধে সমিতির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।’