নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদন নিয়ে জালিয়াতি করেছে দেশের ৩৩ হাজার কোম্পানি। এক্ষেত্রে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের স্বাক্ষর জাল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। মূলত কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যেই এই জাল অডিট জমা দেয়া হয়েছে। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। এনবিআরের আয়কর রিটার্ন এবং অডিট ফার্মের তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এছাড়া কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত হলেও একই বছর কোনো আয়কর রিটার্ন দাখিল করেনি ১ লাখ ১১ হাজার প্রতিষ্ঠান। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে বিষয়টি তদন্ত করা উচিত। কারণ এর সঙ্গে রাজস্ব খাতের সুশাসন জড়িয়ে আছে।
পাশাপাশি সিএ ফার্মগুলোর সংগঠন ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) নেতারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা এনবিআরের সঙ্গে আলাপ করেছে।
এ ব্যাপারে এনবিআরকে একটি সফটওয়্যার দেয়া হয়েছে। রিটার্ন দাখিলের পদ্ধতি ডিজিটাল হলে জাল-জালিয়াতি অনেকটা কমবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কারা অডিট করতে পারবে, এ ব্যাপারে একটি গাইডলাইন আছে।
এ অবস্থায় অডিটের চেয়ে এনবিআরের রিটার্ন দাখিল বেশি হলে অবশ্যই তা তদন্ত করা উচিত। এ ব্যাপারে এনবিআরকে উদ্যোগ নিতে হবে।
এছাড়া এ ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলও ভূমিকা রাখতে পারে।
জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোকে এনবিআরে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হলে অডিট করা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে সরকার অনুমোদিত ১৫৪টি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্মের মাধ্যমে অডিট করাতে হবে। এর বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানের অডিট করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট ফার্মগুলোর তথ্যে দেখা গেছে, গত বছর ২২ হাজার কোম্পানির হিসাব অডিট করা হয়েছে।
কিন্তু এনবিআরের হিসাবে আলোচ্য সময়ে ৫৫ হাজার কোম্পানি রিটার্ন জমা দিয়েছে। সে হিসাবে ৩৩ হাজার কোম্পানি ভুয়া অডিটের মাধ্যমে রিটার্ন জমা হয়। ফলে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিএ ফার্মগুলোর জালিয়াতি থাকতে পারে। হয়তো তারা অডিটের তথ্য গোপন করেছে।
অন্যদিকে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) তথ্য অনুসারে সারা দেশে নিবন্ধিত মোট কোম্পানি সংখ্যা ৩ লাখ। এর মধ্যে রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টকে (আরজেসি) নিবন্ধিত কোম্পানি ২ লাখ ১৩ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সংগঠনও রয়েছে। এককভাবে আরজেসিতে কোম্পানিগুলোর হিসাব করলে নিবন্ধিত কোম্পানি ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০।
এর মধ্যে সরকারি কোম্পানি ৩ হাজার ৫০০ এবং বেসরকারি কোম্পানি ১ লাখ ৬২ হাজার। আর গত বছর এনবিআরে রিটার্ন দাখিল করেছে মাত্র ৫৫ হাজার।
অর্থাৎ ১ লাখ ১০ হাজার ৫০০ কোম্পানি আয়কর রিটার্ন দাখিল করেনি। কিন্তু কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি।
জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য কালিপদ হালদার বলেন, এটা ভেবে দেখার বিষয়। ঘটনা সত্য হলে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। কারণ এখানে অডিট রিপোর্ট জাল-জালিয়াতি হতে পারে। তিনি বলেন, সিএ ফার্মের রিপোর্টে এ রকম কিছু থাকলে বিষয়টি এনবিআর অবশ্যই বিবেচনায় নেবে।
আইসিএবির প্রেসিডেন্ট এএফ নেসার উদ্দিন এফসিএ বলেন, আমাদের ধারণা, এ কোম্পানিগুলোর অডিট হয়নি। তারা অডিট না করেই কোনো জায়গা থেকে ভুয়া অডিট নিয়ে রিটার্ন জমা দিয়েছে।
বাংলাদেশে অনেক কিছুই হয়। ধারণা করছি, ওই রকম কিছু হয়েছে। তার মতে, এটি তদন্ত হওয়া দরকার। না হলে সমস্যার সমাধান হবে না।
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে এই সমস্যার সমাধানে ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। এরই মধ্যে আমরা ডিজিটাল আইডেনটিফিকেশন অব অডিট রিপোর্ট নামে এ সংক্রান্ত একটি সফটওয়্যার এনবিআরকে দিয়েছি।
এর মাধ্যমে দেখা যাবে কারা কোন কোম্পানি অডিট করেছে। অডিট কোম্পানিগুলোও তথ্য গোপন করছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটিও হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে এনবিআরের বিষয়টি যাচাই করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, অনুমোদিত অডিট ফার্মের সংখ্যা মাত্র ১৫৪টি। এখানে যাচাই-বাছাই করা তেমন কঠিন কাজ নয়। সেক্ষেত্রে কোনো অডিট রিপোর্ট এলে, এনবিআর ওই ফার্মকে জিজ্ঞাসা করতে পারে- তোমরা অডিট করেছ কি না।
এছাড়াও রিটার্ন জমা দেয়ার পর অডিট ফার্মের কাছ থেকেও এনবিআর সরাসরি একটি সার্টিফিকেট নিতে পারে। এতে বিষয়টি আরও সহজ হবে।
জানতে চাইলে সরকারি প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ এফসিএ বলেন, সাধারণত কোম্পানিগুলো অডিটরের স্বাক্ষর জাল করে এ ধরনের কাজ করে থাকে।
তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। অডিট ফার্ম, রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক এবং এনবিআরের রিপোর্ট একত্রিত করে সমস্যা চিহ্নিত করব। আইসিএবির অনুমোদিত অডিট ফার্মের প্রতিবেদন, এনবিআরের গৃহীত রিটার্নের তথ্য এবং জয়েন্ট স্টকে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর তথ্য আমাদের কাছে দিতে হবে। এ তিন প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট সমন্বয় করলেই অডিটে জাল-জালিয়াতির বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।
জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কোম্পানির জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার পদ্ধতি ভিন্ন। এক্ষেত্রে কোম্পানির ব্যাংক স্টেটমেন্টের কপি, কোম্পানির ইনকর্পোরেশন সার্টিফিকেটের কপি, মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস, ট্রেড লাইসেন্স, সব পরিচালকের টিন সার্টিফিকেট এবং কোম্পানির আয়-ব্যয়ের রশিদের কপি বাধ্যতামূলক।
আর এই কাগজপত্রগুলো নিয়ে একজন স্বীকৃত চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের কাছে যেতে হবে। কোম্পানির কাগজপত্র অডিট রিপোর্ট তৈরি করবে।
এর মধ্যে কোম্পানির আয়, ব্যয়, ক্যাশফ্লো, সম্পদ এবং নিট মুনাফার একটি ব্যালেন্স শিট থাকবে। এর ওপর ভিত্তি করে কোম্পানির কর নির্ধারিত হয়।
আইসিবির তথ্যানুসারে, বর্তমানে সারা দেশে ১৫৪টি অডিট ফার্মে ৩৬৭ জন অংশীদার রয়েছে। এর বাইরে কারও অডিট করার সুযোগ নেই।