করদাতার গোপন তথ্য তলব ও নথি জব্দের ক্ষমতা চায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অপরাধবিষয়ক মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করতে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এ ক্ষমতা চেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থাটি। এ জন্য দুদক আইনের বিধিমালাও সংশোধন করা হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে দুদকের এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এনবিআর বলেছে, আয়কর আইনের ১৬৩ ধারায় করদাতার যাবতীয় তথ্য সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এনবিআর মনে করে, তথ্য গোপন রাখার অর্থ হচ্ছে করদাতার আমানত রক্ষা করা। এমন প্রতিশ্রুতি মেনেই কর আহরণ করা হয়। এখন যদি দুদককে আয়কর নথিসহ সব তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তা হবে করদাতার প্রতি আস্থা ভঙ্গ। পাশাপাশি তাদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হবে। এতে উল্টো কর আদায় ব্যাহত হতে পারে। অবশ্য এনবিআরের এ যুক্তি মানতে রাজি নয় দুদক। তারা বলছে, অপরাধীকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে প্রত্যেক সংস্থা বা ব্যক্তির কাছ থেকে সব ধরনের তথ্য বা নথি চাইতে পারে দুদক। কাজেই এনবিআরের অভিযোগ সঠিক নয়। দুদক সূত্রে জানা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। তদন্ত ও অনুসন্ধান কাজে গতি আনতে বিধি সংশোধনের মাধ্যমে দুদকের বর্তমান আইন হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত মাসের প্রথমদিকে দুদক থেকে এনবিআরের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়- অনুসন্ধান বা তদন্ত কাজে নিয়োজিত দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা আবশ্যক মনে করলে আয়কর অফিস থেকে আয়কর রিটার্ন, বিবরণী, সাক্ষ্য-প্রমাণ, কর নিরূপণ নথি, দলিলপত্র দুদকের আইন ও বিধান মোতাবেক পরীক্ষা বা জব্দ ও তলব করতে পারবে। এতে অন্য কোনো আইনের বিধান বাধা হবে না। এনবিআর সূত্র জানায়. কোন কোন ক্ষেত্রে করদাতার তথ্য দিতে পারে,
সে বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে বিদ্যমান আয়কর আইনে। বর্তমানে নির্দিষ্ট মামলায় অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে (অর্থ পাচার সংক্রান্ত) দুদকের পক্ষ থেকে করদাতার সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হলে তা লিখিতভাবে সরবরাহ করে এনবিআর। এ ছাড়া আদালত চাইলে তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এর বাইরে দেওয়া যায় না। কিন্তু দুদক চাচ্ছে ঢালাওভাবে তথ্য তলবের ক্ষমতা।
সূত্র বলেছে, এ প্রস্তাব কার্যকর হলে দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা সরাসরি করদাতার গোপন তথ্যসহ সব নথিপত্র জব্দ করতে পারবে, যা বিদ্যমান আয়কর আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এনবিআর কর্মকর্তরা বলেছেন, প্রচলিত আইনের নিয়ম লঙ্ঘন করে করদাতার তথ্য সরবরাহ করলে দায়ী কর কর্মকর্তার জেল-জরিমানাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান রয়েছে। তা ছাড়া শুধু বাংলাদেশে নয়, প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশেও কর আইনে করদাতার গোপন তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা আছে।
গত ২৩ এপ্রিল আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে এক বৈঠকে দুদকের বিধি সংশোধনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে করদাতার তথ্য গোপন সংক্রান্ত দুদকের প্রস্তাবের বিপক্ষে এনবিআর। অপরদিকে দুদক বলেছে, এটি নতুন কিছু নয়। বহু আগের প্রস্তাব। তা ছাড়া এ বিষয়ে উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা কার্যকর করতে এ উদোগ নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া, আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
যোগাযোগ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, সুনির্দিষ্ট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক তথ্য দুদক থেকে চাওয়া হলে সে ক্ষেত্রে এনবিআর তা সরবরাহ করবে। এর বাইরে ঢালাওভাবে করদাতার কোনো তথ্য দিতে হবে না। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই।
এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, আমরা শক্তভাবে বলেছি, আয়কর আইনে যা আছে সে অনুযায়ী বা মামলার প্রয়োজনে করদাতার তথ্য দেওয়া হবে। এর বাইরে নয়।
দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) মঈদুল ইসলাম বলেন, দুদক অন্যদের মতো সাধারণ সংস্থা নয়; তদন্তকারী সংস্থা। দুদকের অধিকার আছে অনুসন্ধান করে অপরাধীকে খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর। তদন্তের স্বার্থে যে কোনো সংস্থার কাছ থেকে সব ধরনের তথ্য তলব করতে পারে দুদক। ফলে করদাতার তথ্য গোপন বিষয়ে এনবিআরের আইনে যে বিধান রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। তিনি বলেন, অহেতুক যুক্তি দেখিয়ে ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা করছে এনবিআর। তা ছাড়া এ বিষয়ে ২০১৬ সালে আপিল বিভাগ একটি রায় দিয়েছেন। দুদক সেই রায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, দুদকের সঙ্গে এনবিআরসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থার (আন্তঃসংস্থা) মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলে দুদকের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়। সম্পর্ক খারাপ থাকলেই সমস্যা তৈরি হবে। তবে এনবিআর সব সময় দুদককে সহযোগিতা করে আসছে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুর রহমান বলেন, সাধারণত মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়ে দুদকের পক্ষ থেকে করদাতার তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করে এনবিআর। এর বাইরে কোনো ফাইল বা ডকুমেন্ট দেওয়া হয় না। এখন বিধি সংশোধন করে এ প্রস্তাব কার্যকর হলে, তা হবে এনবিআরের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।