আগামী ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়িত হচ্ছে ভ্যাট আইন। এ আইনে সিমেন্ট খাতে যে করারোপ করা হয়েছে, তাতে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ৪২ টাকা বাড়বে। এতে একদিকে যেমন আবাসন খাতে প্রভাব পড়বে, একই সঙ্গে সরকারের অবকাঠামো খাতের বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যয়ও বাড়বে। পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাজেটে চাপে থাকা মধ্যবিত্তদের ওপর খড়্গ পড়ার তালিকায় আরেকটি পণ্যের নাম যুক্ত হবে বলে আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্যক্তিগত গৃহ নির্মাণ খরচ অনেক বেড়ে যাবে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাসন খাত চাঙ্গা করার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা অনেকটাই বিফলে যাবে, যদি অগ্রিম কর বা অ্যাডভান্স ট্যাক্স প্রত্যাহার করা না হয়। এবারের বাজেটে অন্যতম বৃহৎ খাত অবকাঠামো উন্নয়ন। সিমেন্টের ব্যয় বৃদ্ধিতে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ও বাড়বে। দেশে এখন পদ্মা সেতু, ঢাকা উড়াল সেতু, ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। কিন্তু বস্তাপ্রতি সিমেন্টের দাম ৪২ টাকা বাড়লে এসব প্রকল্পের গতিও ব্যাহত হবে।
সওজ অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা জানান, অধিদপ্তরের প্রকল্প ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় রেট সিডিউলের ওপর ভিত্তি করে। নির্মাণসামগ্রীর দরের ওপর ভিত্তি করে রেট সিডিউল তৈরি করা হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে রেট সিডিউল নির্ধারণ করেছে সওজ অধিদপ্তর। এবার সিমেন্টের দাম বাড়লে সিডিউল রেট হার নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। অধিদপ্তরের ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দিন খান বলেন, সড়ক উন্নয়নের যে বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে ও হয়েছে, সেগুলোর ব্যয় বেড়ে যেতে পারে সিমেন্টের দাম বাড়লে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান এবং ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল খালেক বলেন, বর্তমানে সিমেন্ট সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট দিতে হয় ১৫ শতাংশ। আমাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় করলে এর জন্য ব্যাংক ঋণ করতে হবে। ব্যাংকঋণের জন্য আমাদের সুদের হার বৃদ্ধি পাবে। এই অতিরিক্ত ৫ শতাংশ পরে সমন্বয় করা সম্ভব হবে না। কারণ এই শিল্পে শুধু গ্রান্ডিং ও মিক্সিং করা হয়। এটি শতভাগ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর শিল্প। মূল্য সংযোজনের হার খুবই কম। ফলে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ আগাম কর সমন্বয়ের সুযোগ নেই। এতে ব্যাগপ্রতি দাম বাড়বে ৪২ টাকা।
আবাসন খাতের মালিকদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসন খাতের অন্যতম প্রধান উপকরণ সিমেন্ট সেক্টরে অগ্রিম কর ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে আবাসন খাতে প্রভাব ফেলবে। ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসন খাত চাঙ্গা করার জন্য যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা থেকে আমরা বঞ্চিত হব।
বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর (এটি) অতিরিক্ত ৫ শতাংশ। এর ফলে এখন মোট ২০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এ ছাড়া আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-র ধারা সি অনুসারে আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ উেস কর্তনকৃত অগ্রিম আয়কর এবং স্থানীয় সরবরাহ পর্যায়ে ৩ শতাংশ উেস কর্তনকৃত অগ্রিম আয়কর ন্যূনতম আয়কর হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এ খাতে ট্যাক্স অন ট্যাক্স হয়ে যাবে। আর এতে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে দাম বাড়বে ৪২ টাকা। কারণ ভ্যাট ও অগ্রিম কর আরোপ করার কারণে সিমেন্টের এক টন কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বাড়বে ৮৫০ টাকা। এক টনে ২০ ব্যাগ সিমেন্ট হয়। সে হিসাবেই প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে দাম ৪২ টাকা বাড়ে। তবে অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হলে এ খরচ কমে আসবে।
সিমেন্ট শিল্পে বছর বছর চাহিদা বাড়ছে। দেশের মোট সিমেন্টের ২৫ শতাংশ ব্যবহার করে ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাতারা। ৩৫ শতাংশ করে আবাসন ব্যবসায়ীরা। বাকি ৪০ শতাংশ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নকাজে ব্যবহার করা হয়। সিমেন্ট শিল্প মালিকদের হিসাবে, দেশের মোট সিমেন্ট উত্পাদন ক্ষমতা বছরে তিন কোটি টন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ আবাসন খাতের সব প্রকল্পে দেশের উত্পাদিত সিমেন্ট সরবরাহ করা হচ্ছে। সিমেন্টের দাম বাড়লে এসব বড় প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। অর্থাৎ শুধু ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আরোপের কারণে সিমেন্ট শিল্পের পাশাপাশি আবাসন খাত এবং সরকারের বড় প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সংশ্লিষ্টদের এ দাবির সঙ্গে অনেকটাই একমত পোষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম এ বাকী খলীলী বলেন, এ খাতে বাড়তি কর ধার্য করার ফলে সরকারের রাজস্ব যে বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর ফলে বিনিয়োগ ব্যয় বেড়ে যাবে। বড় বড় প্রকল্পের ব্যয় আরো এক দফা বাড়বে। পাশাপাশি সিমেন্টের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাবে। সর্বোপরি মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ বাড়বে।