নানা কায়দায় কর ফাঁকি দিতে ভয়াবহভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মেঘনা গ্রুপ। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে গ্রুপটি দেড় হাজার কোটি টাকার শুল্ক কর থেকে সরকারকে বঞ্চিত করেছে। এই গ্রুপেরই প্রতিষ্ঠান তানভীর ফুডস লিমিটেড গুঁড়া দুধ আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অর্থপাচারে জড়িত। দেশের শীর্ষ কর ফাঁকিবাজ মেঘনা গ্রুপের এসংক্রান্ত অনিয়মের ফাইল পাঁচ বছর ধরে ধামাচাপা পড়ে আছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী গতকাল বলেন, ২০১৪ সালের অক্টোবরে অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় তানভীর ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালকে দুদকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দেড় হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা অনুসন্ধানে নেমেছিল দুদক।
জানা গেছে, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এফ মোস্তফা কামালকে ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। ওই দিন বিকেল ৩টা ২০ মিনিট থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এই কর ফাঁকিবাজকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী। জিজ্ঞাসাবাদে মোস্তফা কামাল ২০১০ ও ২০১১ সাল পর্যন্ত আমদানি করা গুঁড়া দুধের এলসি, ক্লিয়ারিং-ফরোয়ার্ডিং রেকর্ডপত্রের কপি জমা দেন। অনুসন্ধানের প্রয়োজনে আরো রেকর্ডপত্র সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি পরে দুদককে তা আর সরবরাহ করেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৭০ শতাংশ গুঁড়া দুধ আমদানি হয় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস থেকে। আর গুঁড়া দুধ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের পাশাপাশি মূল্য পরিশোধ দেখিয়ে এই অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার করে।
কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে কম মূল্য দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান তানভীর ফুডস লিমিটেড গুঁড়া দুধ আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি দিতে এভাবে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে এমন তথ্য পেয়েছে দুদক। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের বাড়তি টাকাটা তারা হুন্ডির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠিয়েছে। এভাবে তানভীর ফুডস প্রতি টন গুঁড়া দুধের বিপরীতে রপ্তানিকারক দেশগুলোতে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছে এক থেকে দেড় হাজার ডলার।
এভাবে ২০১১ সালের ১১ জুলাই ভ্যালুয়েশন প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, প্রতি টন গুঁড়া দুধ আমদানি করতে একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ড ব্যয় করেছে চার হাজার ৪০০ ডলার। অথচ একই সময়ে তানভীর ফুডস লিমিটেড ফ্রেশ গুঁড়া দুধ আমদানি করতে টনপ্রতি ব্যয় দেখিয়েছে মাত্র দুই হাজার ৭০০ ডলার।
অস্ট্রেলিয়ার ইকোভাল ডেইরি ট্রেডের তথ্যানুসারে, ২০১১ সালের ২১ জুলাই বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রতি টন গুঁড়া দুধ বিক্রির মূল্য উল্লেখ করা হয়েছে তিন হাজার ৭৯০ ডলার। অথচ একই সময়ে তানভীর ফুডসকে সরবরাহ করা প্রতি টন গুঁড়া দুধের মূল্য দেখানো হয়েছে দুই হাজার ৪৮০ ডলার। অর্থাৎ প্রতি টনে আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে এক হাজার ৩১০ ডলার। এভাবে প্রতি ৫০ টনে ৬৫ হাজার ৫০০ ডলার পাচার করা হয়েছে। মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় বাজারে আবার ঠিকই উচ্চমূল্যে গুঁড়া দুধ বিক্রি করছে।
জানা গেছে, ২০০৯ ও ২০১০ সালে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার শুল্ক কর থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। ওই দুই বছরে বিশ্ব বাজারে প্রতি টন গুঁড়া দুধের মূল্য ছিল তিন হাজার ৭০০ ডলার থেকে তিন হাজার ৮০০ ডলার। এই তথ্য আমলে নিয়ে দুদক বিষয়টির ওপর অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় তলব করা হয় মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালকে।