এখন শুধু টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) সনদ থাকলেই গাড়ি রেজিস্ট্রেশন-নবায়ন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ-নবায়ন, ঠিকাদারি কাজে অংশ নেওয়া যায়। আগামীতে রিটার্ন জমার স্লিপ (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) ছাড়া এসব সরকারি সেবা পাওয়া বা টেন্ডারে অংশ নেওয়া যাবে না। সব ক্ষেত্রেই রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক হচ্ছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ২৫ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১৬ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহ হচ্ছে- অর্থবিভাগ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, সড়ক পরিবহণ বিভাগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, রেলপথ বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক।
জানা গেছে, গত ১৫ মার্চ অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আয়কর রিটার্ন জমা ও উৎসে কর কর্তন কার্যক্রম বেগবান করতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা হয়। সেখানে ১০ মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা সবাই রিটার্ন জমা বাড়াতে টিআইএন সনদের বদলে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন। এর পরই এসব চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে কোনো পণ্য সরবরাহ, চুক্তি সম্পাদন বা সেবা দেওয়ার জন্য দরপত্র জমার ক্ষেত্রে ই-টিআইএন সার্টিফিকেট দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে। একইভাবে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন, গাড়ি রেজিস্ট্রেশন-নবায়ন, নৌযান রেজিস্ট্রেশন-নবায়ন, আমদানি-রফতানি সনদ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তি ও নবায়নে ই-টিআইএন সনদ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আছে।
দেখা যাচ্ছে, টিআইএনধারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনলাইন থেকে এই সনদ নিয়ে সব সুবিধা ভোগ করলেও আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছে না। ফলে রিটার্ন জমার হার বাড়ছে না। বড় একটি অংশ করের আওতার বাইরে থাকছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করজাল বাড়াতে এটা ভালো উদ্যোগ হতে পারে। কারণ আইনে সব টিআইএনধারীর রিটার্ন জমা দেওয়ার কথা বলা থাকলেও অনেকে রিটার্ন জমা দেন না। এটি চালু করা গেলে রিটার্ন জমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে একজন গাড়ির মালিক রিটার্ন জমা না দিয়ে শুধু ই-টিআইএনের মাধ্যমে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করতে পারছে। আয়কর আইনে রিটার্ন জমা না দেওয়ার কারণে টিআইএন প্রত্যাহার বা বাতিলের সুযোগ নেই। তাই টিআইএনধারীদের রিটার্ন জমা না দিয়ে আয় গোপন ও কর ফাঁকির সুযোগ থেকে যাচ্ছে।
এছাড়া দরপত্রে অংশগ্রহণ, ঠিকাদারি তালিকাভুক্তিসহ সব ক্ষেত্রে রিটার্নের প্রাপ্তিস্বীকারপত্র জমার বাধ্যবাধকতা মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করলে কর জাল ও কর কমপ্লায়েন্স বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটি ভালো উদ্যোগ। এর ফলে নিঃসন্দেহে রিটার্ন জমা বাড়বে। কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে মানুষের হয়রানিও বেড়ে যেতে পারে। এখন প্রাপ্তিস্বীকারপত্র পেতে যে ধরনের কষ্ট ও পয়সা খরচ করতে হয়, সেটি আরও বাড়বে।
কারণ তখন সেবা পেতে প্রাপ্তিস্বীকারপত্র লাগবেই। বাধ্য হয়েই মানুষ কষ্টও করবে, বেশি পয়সাও খরচ করতে হবে। তিনি বলেন, এ উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাবে একমাত্র অটোমেশনের মাধ্যমে। অনলাইনে করদাতা রিটার্ন জমা দেবে, অনলাইনের তাকে যদি প্রাপ্তিস্বীকারপত্র দেওয়া যায়, তাহলে এটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা সাড়ে ৬১ লাখের বেশি। কিন্তু রিটার্ন দাখিল করেন সাড়ে ২৫ লাখ করদাতা। যা বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একেবারেই বেমানান। রিটার্ন কম জমার কারণ হচ্ছে, আয়কর আইনে সরকারি-বেসরকারি সেবায় টিআইএন বাধ্যতামূলক করা আছে। তাই সেবা পেতে অনেকে টিআইএন নেন, কিন্তু করযোগ্য আয় থাকা সত্ত্বেও রিটার্ন জমা দেন না।
মাঠ পর্যায়ের আয়কর অফিসে লোকবল সংকট থাকায় নিয়মিত জরিপ চালানোও যাচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের আইন, বিধি বা আদেশে টিআইএনে বদলে প্রাপ্তিস্বীকারপত্র বাধ্যতামূলক করে তাহলে রিটার্ন জমা বাড়ার পাশাপাশি কর আদায়ও বাড়বে।