অনলাইনে ৯৬ ঘণ্টা ভ্যাট কার্যক্রম বন্ধ থাকবেরমজানে ভোজ্যতেলের দাম কমাতে কর অব্যাহতিখোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানের শুল্ক বাকি ১৮ হাজার কোটি টাকা, ৩৭ চিঠি দিয়েও ব্যর্থ এনবিআরভ্যাটের একক রেট করতে পারলে ফাঁকি কমে যাবেজুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনায় জাতীয় ভ্যাট দিবস উদযাপন
No icon

শর্ত সাপেক্ষে কমছে করপোরেট করহার, রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট-ট্যাক্সে নজর দিচ্ছে সরকার

শর্ত সাপেক্ষে করপোরেট কর কমছে। কর অব্যাহতির তালিকা ছোট করা হচ্ছে। পাচার হওয়া অর্থ বিনা প্রশ্নে সাদা করার সুযোগ থাকছে। মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডে কর অব্যাহতি সুবিধা অব্যাহত থাকছে। রিটার্ন দাখিল আর করদাতা বাড়াতে ই-টিআইএনের পরিবর্তে দিতে হবে রিটার্ন প্রাপ্তি স্বীকার বা কর সনদ। ফ্রিজ ও মোবাইলে ভ্যাট বসছে। কমছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে দুই শতাধিকের বেশি পণ্যে রেগুলেটরি ডিউটি অব্যাহত থাকবে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ককর ছাড়ের আওতা বাড়ছে। নিন্মস্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে। এছাড়া আসন্ন বাজেটে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে এ রকম কিছু প্রস্তাবনা থাকছে। মূলত করজাল বাড়াতে এসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে বাজেটে রাজস্ব খাতে তেমন চমক নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হচ্ছে। তবে এ ছাড় পেতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিগুলোকে শর্ত পূরণ করতে হবে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে কর হার কমার পরিবর্তে আড়াই শতাংশ বাড়বে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। আগামী বাজেটে এটি কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হচ্ছেÑযেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে বাজারে ছাড়া হয়েছে, তারাই কেবল এ সুবিধা পাবে।

আর দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে বার্ষিক সর্বমোট ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত নগদ ব্যয় ও বিনিয়োগ ছাড়া সব ধরনের লেনদেন ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে পুঁজিবাজারে ১০ শতাংশ শেয়ার ছাড়া থাকলেও ওই কোম্পানিকে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে করপোরেট কর দিতে হবে। এ ছাড়া একক ব্যক্তির মালিকানাধীন কোম্পানির (ওপিসি) ক্ষেত্রেও একই শর্ত দিয়ে করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হচ্ছে। অন্যদিকে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় আনতে চলতি অর্থবছর বাজেটে কর ছাড় সুবিধা দেয়া হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটেও প্রতিবন্ধীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে একই ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কঠিন শর্তের বেড়াজালে এ সুবিধা নিতে পারেনি কোনো প্রতিষ্ঠানই। তাই আগামী বাজেটে শর্ত শিথিল করা হচ্ছে।

অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রথমবারের মতো পাচারকারীদের ট্যাক্স অ্যামনেস্টি (আয়কর দিলে দণ্ড মাফ) সুবিধা দেয়া হবে। এর মাধ্যমে কেউ অর্থ ফেরত আনলে দেশের অন্য কোনো আইনে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। এ সুবিধা এক বছরের জন্য দেয়া হচ্ছে। অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ বহু আগে থেকেই দিয়ে আসছে সরকার। তবে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ আগে কখনও দেয়া হয়নি। এ সুযোগ দেয়া হলে বাংলাদেশি নাগরিকরা বিদেশে তাদের সম্পদের তথ্য আয়ের বিবরণীতে যুক্ত করার সুযোগ পাবেন, ওই অর্থের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না।

সূত্রমতে, বাজেটে তিনভাবে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দেয়া হবে। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি থাকলে সেই সম্পত্তি দেশের আয়কর রিটার্নে দেখাতে চাইলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অস্থাবর সম্পত্তির ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হবে। তৃতীয়ত, কেউ বিদেশ থেকে টাকা দেশের আনলে সেই টাকার ওপর সাত শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবে টাকা যোগ হওয়ার আগেই কর পরিশোধ করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। এমনকি আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে না। অন্যদিকে দেশ থেকে যে টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে তা আবার দেশে ফেরানোর সুযোগ দিতে বাজেটের আগেই ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি একটি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেছেন, ‘বিভিন্ন সময় যেসব টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে গেছে, আমরা বিভিন্নভাবে এসব টাকা ফেরতের সুযোগ দিতে অ্যামনেস্টি দিচ্ছি, যাতে টাকাগুলো আমাদের দেশে ফিরে আসে, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।’

আগামী বাজেটে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ই-টিআইএনের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র (প্রাপ্তি স্বীকার বা আয়কর সনদ) বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। মূলত রিটার্ন দাখিল বাড়ানো ও করযোগ্য ব্যক্তিদের করের আওতায় আনতে বাজেটে এই ঘোষণা আসতে পারে। বর্তমানে প্রায় ৪০ ধরনের সেবা নিতে হলে ই-টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক।

সূত্রমতে, আগামী বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলে বিপুলসংখ্যক করদাতা করনেটের বাইরে চলে যেতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকে সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে করমুক্ত আয় সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হয়। সারচার্জ বা সম্পদ কর হারে পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। হাঁস-মুরগির খামারিদের কর বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে হাঁস-মুরগির খামারের মালিকদের ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। এটি কমিয়ে ১০ লাখ টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া আগের নিয়মেই হাঁস-মুরগি, চিংড়ি ও মাছের হ্যাচারি এবং মৎস্য চাষ থেকে অর্জিত আয়ের ওপর কর দিতে হবে।

অন্যদিকে দেশীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ ও দেশীয় পণ্যকে ব্র্যান্ডিং করার অংশ হিসেবে আগামী বাজেটেও ‘মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড’ সুবিধা অব্যাহত রাখা হচ্ছে। দেশীয় শিল্প খাতকে সুবিধা দিতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো ‘মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড’ সুবিধা চালু করা হয়, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর সুবিধা দেয়া হয়। তবে আসন্ন বাজেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড’ প্রতিষ্ঠায় নতুন করে আরও বেশ কিছু দেশীয় শিল্প খাতকে কর সুবিধা দেয়া হবে। এ ছাড়া করোনা-পরবর্তী ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষায় আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। চলতি বাজেটে অটোমোবাইল, থ্রি হুইলার, ফোর হুইলার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও হালকা প্রকৌশল শিল্পকে ১০ বছর কর অব্যাহতি দেয়া হয়।

এছাড়া কিছু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এটি বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাজারে ফ্রিজের দাম বাড়তে পারে। পাশাপাশি মোবাইল সেট বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট নেই। ব্যবসা পর্যায়ে মোবাইল সেটের ওপর বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। এতে মোবাইলের দাম বাড়তে পারে। আবার কয়েকটি খাতে ভ্যাট হার কমানো হচ্ছে। এর মধ্যে হোটেল-রেস্টুরেন্টের ভ্যাট কমানো হচ্ছে। বর্তমানে এসি রেস্টুরেন্টে খেতে ১০ শতাংশ এবং নন-এসি রেস্টুরেন্টে খেতে পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। আসন্ন বাজেটে উভয় ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। অপরদিকে জুয়েলারি শিল্পের ভ্যাট পাঁচ শতাংশ থেকে কমিয়ে তিন শতাংশ করা হচ্ছে। ভ্যাট রিটার্ন দাখিলে (দাখিলপত্র) ব্যর্থতার জরিমানা ১০ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হচ্ছে। আর ভ্যাট ফাঁকি, ব্যর্থতা ও অনিয়মের ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে অর্ধেক করা হচ্ছে।

অপরদিকে, জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেটে জনগণের ওপর নতুন করে করের বোঝা চাপানো হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থমন্ত্রী এ আশ্বাস দেন। মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের মানুষের কষ্ট বা ভোগান্তি যাতে করে না বাড়ে এবং তাদের ওপরে যেন বোঝা বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি, এগুলো কমবেশি বিবেচনায় নেব। নতুন বাজেট কেমন হবে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ বছরের বাজেট অন্যান্য বছরের মতো নয়। এবার আরও স্বচ্ছ উপায়ে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে।’

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট। আগামী ৯ জুন এ বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটের আকার হবে ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ফলে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের অধীন রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়কর খাতে এক লাখ ১৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা, শুল্ক খাতে ৪২ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, মূসক খাতে দুই লাখ চার হাজার ৭৫ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে পাঁচ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট এটি। ২০১৯ সালের জুনে তিনি তার প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন।