ব্যক্তি করদাতাদের রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় এক মাস বাড়ানো হয়েছে। জরিমানা ছাড়া ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করার সর্বশেষ তারিখ নির্ধারিত থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সময় বাড়িয়েছে। অর্থাৎ ১ জুলাই ২০২৩ থেকে ৩০ জুন ২০২৪ পর্যন্ত সময়ের আয়ের জন্য করদাতারা জরিমানা ছাড়াই এ বছরের শেষ দিন পর্যন্ত রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। তবে চলতি করবছরের আগে যাঁরা টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) নিয়েছেন কিন্তু কোনো কারণে একবারও রিটার্ন দেননি, তাঁরা আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে জরিমানা ছাড়া রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে চলতি ও আগের বছরের রিটার্ন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে জমা দিতে পারবেন।
পুরোনো আইনে করদাতার আবেদনের পরিপেক্ষিতে উপ–কর কমিশনার দুই মাস এবং যুগ্ম কর কমিশনার দুই মাস, অর্থাৎ রিটার্ন জমা দিতে মোট চার মাস সময় বাড়াতে পারতেন। নতুন আইনে এখন আর সে সময় পাওয়া যাবে না। কিন্তু আয়কর রিটার্ন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে জমা দেওয়া যাবে। কিন্তু গুনতে হবে ২ শতাংশ হারে মাসিক জরিমানা। পাশাপাশি কর অবকাশ, হ্রাসকৃত কর হার, কর রিবেট, কর অব্যাহতি কোনো কিছুই পাওয়া যাবে না। ফলে কর দিবসের পর আয়কর রিটার্ন দিলে কয়েক গুণ বেশি আয়কর দিতে হবে।
নতুন ফরম
নতুন আইনে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য নতুন দুটি ফরম প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে পুরোনো ফরমগুলো চালু আছে। এ ক্ষেত্রে পুরোনো ফরমের ধারাগুলো নতুন আইনের ধারা অনুসারে আপডেট করতে হবে।
আমরা জমি, ফ্ল্যাট, স্থায়ী আমানত বা এফডিআর, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির দলিল বা নথি যেভাবে সংরক্ষণ করি, প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় আয়করের ফাইল সেভাবে সংরক্ষণ করি না। আয়কর ফাইল ঠিকভাবে রাখা কর ব্যবস্থাপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আয়কর আইন প্রায় প্রতিবছর সংশোধন–পরিমার্জন হয়। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা, যাঁরা চাকরিজীবী বা ছোটখাটো ব্যবসা করেন, তাঁদের রিটার্ন দাখিল করতে খুব একটা অসুবিধা হয় না, তবে এ ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।
এ বছর ৩০ জুনের আগে যাঁরা টিআইএন গ্রহণ করেছেন, তাঁদের আয়কর রিটার্ন দিতে হবে। এ বছর ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার জন্য অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ফলে অল্প সময়ে রিটার্ন জমা দেওয়া সম্ভব। যাঁদের মোট পরিসম্পদ ৫০ লাখ টাকা এবং আয় ৫ লাখ টাকার নিচে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা শুধু এক পাতার ফরম পূরণ করে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।
করমুক্ত আয়সীমা
করমুক্ত আয়সীমা ব্যক্তিশ্রেণির পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, নারী অথবা ৬৫ বছরের অধিক পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতার ক্ষেত্রে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা। আবার কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পিতামাতা বা আইনানুগ অভিভাবকের জন্য করমুক্ত সীমা ৫০ হাজার টাকা বেশি হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পিতা–মাতা উভয়ে করদাতা হলে যেকোনো একজন এই সুবিধা পাবেন।
কোনো ব্যক্তির আয় নির্ধারিত সীমার নিচে হলে করদাতাকে আয়কর রিটার্ন দিতে হবে কিন্তু কর দিতে হবে না। শুধু করসীমা অতিক্রম করলেই আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ করসীমার ওপর আয় ১ টাকা বেশি হলেও তাঁকে ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে।
ন্যূনতম আয়কর
এ বছর নিয়মিত আয়ের ওপর ন্যূনতম আয়কর ছাড়াও ৪০টি খাতের আয়ের ওপর ন্যূনতম আয়কর ধার্য করা হয়েছে। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী আমানত ও স্থায়ী আমানত, লভ্যাংশ, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল, লটারি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিয়মিত আয়ের পরের স্লাব থেকে কর গণনা করতে হবে। ওই খাতের উৎসে কর অন্য খাতের আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে না। যদি ন্যূনতম খাতের আয়কর কম হয়, তবে অতিরিক্ত কর প্রদান করতে হবে। সঞ্চয়পত্রের ওপর উৎসে কর চূড়ান্ত করদায় অর্থাৎ সঞ্চপত্রের সুদ খাতে অতিরিক্ত কোনো কর দিতে হবে না।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার পাঁচ হাজার টাকা এবং অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার চার হাজার টাকা। সিটি করপোরেশন ব্যতীত অন্যান্য এলাকায় অবস্থিত করদাতাকে ন্যূনতম কর হিসেবে তিন হাজার টাকা প্রদান করতে হবে।
একজন সাধারণ করদাতার কর রেয়াতের জন্য তিনটি বিষয় বিবেচিত হবে। মোট নিয়মিত করযোগ্য আয়ের ৩ শতাংশ (কর অব্যাহতি প্রাপ্ত বা হ্রাসকৃত কর হারের আয় ব্যতীত); বা প্রকৃত অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ; অথবা ১০ লাখ টাকা; এই তিনটির মধ্যে যেটি কম।
করদাতার মোট পরিসম্পদ যদি চার কোটি টাকার বেশি বা একের অধিক মোটরগাড়ি বা আট হাজার বর্গফুটের অধিক আয়তনের গৃহসম্পত্তি থাকে, তাঁকে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ প্রদান করতে হবে।
আয়করের বর্তমান হার
প্রথম ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর শূন্য, পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ, অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ।
আয়কর বিষয়ে কয়েকটি টিপস:
১. গত বছরের রিটার্নের ফটোকপি সঙ্গে রাখুন।
২. প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একটি তালিকা তৈরি করুন।
৩. কাগজগুলো পরীক্ষা করে দেখুন সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ের কি না। যেমন ২০২৪-২৫ করবছরের জন্য সব নথি জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হতে হবে।
৪. রিটার্নের একটি ফটোকপি করুন এবং গত বছরের রিটার্নের ভিত্তিতে খসড়া রিটার্ন তৈরি করুন।
৫. প্রতিটি কাগজের দুটি করে কপি করুন।
৬. স্বাক্ষর করার আগে কমপক্ষে দুবার পরীক্ষা করুন।
৭. যাঁরা নিজে রিটার্ন পূরণ না করে অন্যের ওপর নির্ভর করেন, তাঁরা প্রশিক্ষিত ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির পরামর্শ ছাড়া খালি বা সাদা রিটার্নে স্বাক্ষর করবেন না।
৮. স্বাক্ষর করার আগে গত বছরের সম্পদের বিষয়গুলো ভালো করে পরীক্ষা করুন এবং চলতি বছরের নতুন কোনো সম্পদ থাকলে তা ঠিকমতো উল্লেখ করা হয়েছি কি না, তা–ও ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।
৯. মনে রাখবেন, আয়নার সামনে দাঁড়ালে আপনার চেহারা যেমন দেখা যাবে, রিটার্নে আপনার সম্পদের আয় এবং ব্যয়ের সম্পূর্ণ চিত্র ফুটে উঠবে।
১০. স্বাক্ষর করার পর একটি সেট আপনার ট্যাক্স ফাইলে সংরক্ষণ করুন।
১১. রিটার্ন জমা হওয়ার পর রিটার্ন জমার স্লিপ সংগ্রহ করুন।