গত ১০ বছরে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট, শুল্ক এবং আয়কর আইনের একটিও চালু করা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নতুন আইন তিনটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। নতুন আইন না হওয়ায় রাজস্ব খাতে বড় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কারও হয়নি। পুরোনো ঢাল-তলোয়ার নিয়েই প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের শুল্ক-কর ছাড়ের চাপও মোকাবিলা করতে হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুন মাসে ভ্যাট আইনটি চালুর কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তা দুই বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়। নতুন শুল্ক আইন এখনো সংসদে পাস হয়নি। প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর আইনটির খসড়াই চূড়ান্ত হয়নি।
অথচ গত ১০ বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য বেড়েছে সাড়ে ছয় গুণ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এনবিআরকে ৬১ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। এবার লক্ষ্য প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। যদিও প্রতিবারই লক্ষ্যমাত্রা ১০-২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়। দু-এক বছর ছাড়া প্রতিবারই সেই সংশোধিত লক্ষ্যও অর্জন করা সম্ভব হয় না।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো আইনি সংস্কার সরকারের মেয়াদের প্রথম দিকে করাই ভালো। মেয়াদের শেষ দিকে এ ধরনের নতুন আইন চালু করতে চাইলে সরকারকে অপ্রীতিকর ঘটনার মুখে পড়তে হয়। সর্বশেষ ভ্যাট আইনের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। তাঁর মতে, শুধু আইন করলেই হবে না, পুরো প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এখনো অনেকে কর-শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন। গ্রামেও এখন অনেকেই বছরে আড়াই লাখ টাকার বেশি আয় করেন। তাঁদের করজালে আনার উদ্যোগ নিতে হতে।
কেন চালু হলো না
২০১২ সালে নতুন ভ্যাট আইন করা হয়। তবে সামগ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে নতুন ভ্যাট আইন চালুর কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল, একক ১৫ শতাংশ ভ্যাট হারের পরিবর্তে একাধিক হার করা। আগামী জুলাই মাসে নতুন ভ্যাট আইন চালুর ঘোষণা রয়েছে। কিন্তু দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও দাবিদাওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন আলোচনা করেনি এনবিআর। বর্তমানে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন দিয়ে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে।
আইনটির কোথায় সংশোধন করা হবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। গত মাসে সব কমিশনারের কাছে কোথায় কী ধরনের সংশোধন করা হবে, তা জানতে চেয়েছে এনবিআর। তাঁদের মতামত পাওয়ার পর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে এনবিআর।
আবার নতুন ভ্যাট আইনের প্রভাব মূল্যায়ন করতে সমীক্ষা করার জন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানিয়েছে এনবিআর। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো এতে রাজি হয়নি। আইন সংশোধন, সমীক্ষা, ব্যবসায়ীদের অনাপত্তি এসব কাজ প্রক্রিয়ায় শেষ করে নতুন ভ্যাট চালু করতে সময় আছে মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস।
এনবিআরের সদস্য (মূসক নীতি) রেজাউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন ভ্যাট আইন চালু করতে আমরা প্রস্তুত আছি। ২০১৭ সালে যখন আইনটি চালুর কথা ছিল, তখন ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতির অভাব ছিল। তাঁদের অনলাইনে হিসাব নিকাশ করার জন্য সফটওয়্যার ছিল না। দেড় বছর আগেই তাঁদের কী ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন যদি তাঁরা সেই প্রস্তুতি না নেন, সেটা তাঁদের সমস্যা।
নতুন কাস্টমস আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে ২০১২ সালের দিকে এই নিয়ে কাজ শুরু করে এনবিআর। ব্যবসায়ীদের মতামত নেওয়া, আইনের খসড়া প্রণয়ন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদন, জাতীয় সংসদে পাসসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে নতুন শুল্ক আইনটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেছিল। আইনের খসড়া গত বছর মন্ত্রিসভায় পাস করা হয়। কিন্তু এখনো জাতীয় সংসদে পাঠানো হয়নি। আগামী বাজেট অধিবেশনে আইনটি সংসদে ওঠানো হতে পারে। এই আইনে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় অটোমেশন ব্যবস্থায় শুল্কায়নকে জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলছে।
বর্তমানের আয়কর অধ্যাদেশও ১৯৮৪ সালের। এ ক্ষেত্রেও নতুন আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ১০ বছর আগে। ইতিমধ্যে আয়কর আইনের ইংরেজি সংস্করণ প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন বাংলা সংস্করণের উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। পুরো আইনটির চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করার জন্য একজন বেসরকারি পরামর্শকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটের আগেই চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। এর পাশাপাশি আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) শুরুতে অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে জাতীয় সংসদে নতুন আয়কর আইনটি পাসের জন্য উত্থাপন করা হবে। আইনটি পাস হলে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে তা চালু করার চিন্তাভাবনা করছে এনবিআর।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান প্রথম আলোকে বলেন, নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা হলো, শুল্ক, কর ও ভ্যাট আইন দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী, নতুন আইনে একাধিক ভ্যাট হার করা হচ্ছে। কাস্টমস আইন ও আয়কর আইনেও ব্যবসায়ীদের মতামতের প্রতিফলন থাকা উচিত। আইনগুলো এমনভাবে করতে হবে যেন ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হয়, ব্যবসায়ীরা সহজে শুল্ক-কর দিতে পারেন, কোনো হয়রানির মুখে না পড়তে হয়।
করদাতা বাড়ছে না
রাজস্ব আদায় বাড়লেও ১০ বছরে করদাতার সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি। ২০০৯-১০ সালে ১১ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএনধারী) বার্ষিক রিটার্ন জমা দিয়েছেন। ১০ বছর পর এসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৭ লাখে। ১০ বছরে প্রকৃত রিটার্ন জমাকারী করদাতা বেড়েছে মাত্র ৬ লাখ। আবার তাঁদের অনেকেই শূন্য রিটার্ন বা ন্যূনতম কর দেন। এখন সারা দেশে ৩৭ লাখের বেশি টিআইএনধারী আছে।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের সাময়িক হিসাবে, অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই সময়ে আদায়ের লক্ষ্য ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ছয় মাসেই রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। ছয় মাসে এনবিআর আদায় করতে পেরেছে পুরো বছরের লক্ষ্যে মাত্র ৩৪ শতাংশ। লক্ষ্য অর্জনে আগামী ছয় মাসে দ্বিগুণ হারে রাজস্ব আদায় করতে হবে।