দেশে উৎপাদিত প্রসাধনীতে করের বোঝা, আমদানিতে ছাড়ভোজ্যতেল আমদানিতে কমলো ভ্যাটখেজুর আমদানিতে শুল্ক ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশঅনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল ও নিবন্ধন করবেন যেভাবেনবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া হচ্ছে ১০ বছরের কর অব্যাহতি
No icon

ডলারের উচ্চমূল‍্যে ঋণখেলাপি হচ্ছেন ব‍্যবসায়ীরা

দেশের আমদানির চেয়ে রপ্তানি আয় কম হওয়ায় এখনো চাপের মুখে ডলার বাজার। অপরদিকে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সুদ ব্যয়ের সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার ও অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। চাপ সামলাতে সময়মতো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না তারা। 

এতে নতুন করে খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকট এখন ব্যবসায়ীদের বড় সমস্যা। সংকটের কারণে এলসি খোলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাড়তি দামে এলসি খুলতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক ব্যবসার ওপর। ফলে ব্যাংক ঋণের কিস্তি শোধ করতে বিলম্ব হচ্ছে। এতে অনেকে খেলাপি হয়ে পড়ছেন। এই অচলাবস্থা রোধে ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

জানা গেছে, দেশের বড়, মাঝারি কিংবা ছোট সব খাতের ব্যবসায়ীদেরই বাড়তি সুদ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। একই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বাড়ছে ব্যাংক খাতে। বাড়তি সুদের চাপে অনেক ভালো গ্রাহকও ঋণের কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছেন না। সুদহার বৃদ্ধির চাপ ব্যবসায়ীদের নতুন সংকটে ফেলেছে। গ্যাস-বিদ্যুতের বিল দ্বিগুণ হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ পরিচালন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ অবস্থায় ঋণের সুদহার দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এভাবে চলতে থাকলে খেলাপি ঋণের চাপ আরো বাড়তে পারে। একই সঙ্গে পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। কয়েক মাস আগে ঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি একই দিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মে মাসে এক দিনের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে মার্কিন ডলারের মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করা হয় ১১৭ টাকা। যদিও ওই দিনের শুরুতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার সর্বোচ্চ ১১০ টাকা নির্ধারিত ছিল। সে হিসাবে এক দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ডলারের ঘোষিত দর আমলে নিয়ে গত দুই বছরের ব্যবধানে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। ৮৪ টাকা থেকে বেড়ে আনুষ্ঠানিক খাতেই প্রতি ডলার এখন ১২১-১২২ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। টাকার এ রেকর্ড অবমূল্যায়নের প্রভাবে আমদানিনির্ভর প্রতিটি পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ব্যবসার ব্যয়। 

সম্প্রতি ডলারের উৎস হিসেবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন কারণে কমেছে রপ্তানির পরিমাণ। এতে দেশে মূলত ডলারের ঘাটতি বেড়েছে। অনেক ছোট কোম্পানি যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেছেন তারাও এখন ঠিকভাবে কিস্তি দিতে পারছেন না। এসব প্রতিষ্ঠান গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি হয়ে পড়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে ‘দেখা গেছে, গত এক বছরে শুধু দুর্দশাগ্রস্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ার বড় কারণ ডলারের দর বৃদ্ধির চাপে ব্যবসায়ীরা সময় মতো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, ডলার সংকটে তারা চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসিও খুলতে পারছেন না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের আমদানি কমার হার ছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি কমার হার প্রায় ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হতো, বর্তমানে আমদানি হচ্ছে তার অর্ধেক। চাহিদা অনুযায়ী মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় দেশের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশ বসে থাকছে। 

একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দরে এলসি খুলতে চায় না। তারা কাগজপত্রে দর যা দেখায় বাস্তবে তার চেয়ে বেশি দিতে হয়। ১১০ টাকার নির্ধারিত দর থাকার সময় কোনো ব্যাংক এই দরে এলসি খুলতে রাজি হয়নি। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকে অতিরিক্ত টাকা দিলেই কেবল এলসি খুলতে রাজি হয়। মানি এক্সজেঞ্জ থেকে ডলার কিনে দিতে হয়। তারা জানান, ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হওয়া, সুদহার বৃদ্ধি, ডলারসংকট ও ডলারের বিনিময় হার নিয়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারা, গ্যাসসংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বিক্রি কমে যাওয়াসহ বহুমুখী সংকটে বেসরকারি খাত এখন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ব্যবসায়ীরা গণহারে ঋণখেলাপি হয়ে যাবেন। তাতে দেশের ব্যাংক খাতের আর্থিক ম্ভিত আরও বেশি নড়বড়ে হয়ে উঠবে। সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ডলারের বিনিময় হার বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। 

২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশের ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত দর হিসেবে প্রতি ডলার ১১৭ টাকা পর্যন্ত। যদিও ঘোষিত দরে দেশের কোনো ব্যাংকেই ডলার মিলছে না। আমদানিকারকদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১২১-১২২ টাকাও আদায় করছে। সে হিসাবে এ সময়ে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ। বিনিময় হার নিয়ে আস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে দেশের ব্যবসায়ীদের ক্ষতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার বলেন, ডলারের সংকট আছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক রেটে ডলার কিনতে এলে, এলসি পরিশোধে বাড়তি দর দিতে হচ্ছে। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত ব্যবসায়ীদের ভর্তুকি দেওয়া। তাদের কিছুটা ছাড় দেওয়া।